আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে যে কারণে হতাশ ফিলিস্তিনিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক
আন্তর্জাতিক জার্নাল আন্তর্জাতিক জার্নাল
প্রকাশিত: ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:১০ AM

গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় অমানবিক ও নৃশংস হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের মামলা করে দক্ষিণ আফ্রিকা। এ মামলার প্রথম রায় দেয় হয় গতকাল শুক্রবার। 

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার করা গণহত্যা মামলায় গাজায় যুদ্ধবিরতির নির্দেশ না দেওয়ায় বিশ্ব আদালত বা আইসিজের রায়ের প্রতি হতাশা প্রকাশ করেছে ফিলিস্তিনিরা। প্রায় চার মাস ধরে চলা বোমা বর্ষণ ও স্থল অভিযান বন্ধের নির্দেশ না আসায় ফিলিস্তিনিরা জানিয়েছেন, এই রায়ে তারা বিধ্বস্ত। বিশ্ব আদালত ব্যর্থ। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এক প্রতিবেদনে খবরটি দিয়েছে।

গতকাল শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) বিশ্ব আদালত ইসরায়েলকে ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশন মেনে চলা, গাজায় আরও মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেওয়া এবং গণহত্যা ঠেকানোর ব্যবস্থা নিতে ইসরায়েলকে নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু রায়ে গাজায় অভিযান বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়নি।

গাজার অনেকেই বলছেন, এই রায়ে তারা হতাশ হলেও বিস্মিত নন। তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বা বিশ্ব বিচার ব্যবস্থাকে বিশ্বাস করেন না কারণ, এই বিশ্ব ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত গাজায় রক্তপাত বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। গত ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় গাজায় মৃতের সংখ্যা ২৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ১৯ লাখ মানুষ।

বাড়িঘর হারানোদের একজন ৫৪ বছর বয়সী আহমেদ আল-নাফফার। তিনি শুক্রবার মধ্য গাজার দেইর এল-বালাহতে আল-আকসা শহীদ হাসপাতালের বাইরে আদালতের রায় অনুসরণ করছিলেন। আল-নাফফার বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর আস্থা না রাখলেও আমার মনে ক্ষীণ আশা ছিল যে, আদালত গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে রায় দেবে। কিন্তু রায় শুনে তার স্বপ্ন ভেঙে যায়। তিনি বলেন, ‘এই আদালত ব্যর্থ।’

হাসপাতালের আঙিনায় আশ্রয় নেওয়া ছয় সন্তানের এই পিতা বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত মর্মাহত যে, কেউই যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে পারছে না। যুদ্ধবিরতির জন্য পদক্ষেপ না নিয়ে আমাদের ধ্বংস দেখছে সবাই। আমরা সাহায্য বা খাদ্য চাই না। আমরা যুদ্ধের অবসান চাই, গাজায় ফিরে যেতে চাই।’

আরেক বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি মোহাম্মদ আল-মিনাভির কাছে আইসিজের রায় শোনাটাও অর্থহীন। ৪৫ বছর বয়সী এই পাঁচ সন্তানের বাবা বর্তমানে আল-আকসা শহীদ হাসপাতালের বাইরে একটি তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছেন। আক্রমণের শিকার হয়ে গাজার পূর্বে আল-মুগরাকা এলাকায় তার বাড়ি থেকে পালাতে বাধ্য হন। আল-মিনাভি বলেন, ‘আমি আশাবাদী নই। দুর্ভাগ্যবশত, কেউ ইসরায়েলকে থামাতে পারবে না।’

তবুও তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা তার কাছে অভূতপূর্ব ঘটনা। তবে, আল-মিনাভির মতে, অন্যান্য দেশ নীরব থাকলে দক্ষিণ আফ্রিকার পদক্ষেপটি অপর্যাপ্ত বলে প্রমাণিত হবে। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলের জন্য কোনো বাধা নেই। সমস্ত আন্তর্জাতিক এবং কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত তাদের সমর্থন করে এবং তাদের কোনো জবাবদিহি নেই।’

আল-মিনাভি বলেন, ‘ইসরায়েল যদি আন্তর্জাতিক আইনের কথা চিন্তা করত, তাহলে তার বাহিনী গাজায় এত নারী ও শিশুকে হত্যা করত না এবং আমাদের সব ঘরবাড়ি ধ্বংস করত না। সবাই বলে, আমরা সাহায্য পাঠাব। ইসরায়েল আমাদের হত্যা করছে আর আপনি সাহায্য পাঠাতে চাপ দিচ্ছেন? আমাদের এখন দরকার সুরক্ষা। বেসামরিকদের লক্ষ্যবস্তু না করার বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ইসরায়েলকে কীভাবে পুরো মাস দেওয়া যায়? এক মাসেই আমরা সবাই ধ্বংস হয়ে যাব!’

খাদ্য এবং পানির ভয়াবহ অভাবের মধ্যেই গাজায় হাজার হাজার গর্ভবতী নারীর একজন তাহরির শেখ খলিল। স্বামী ও পাঁচ সন্তানসহ আল-আকসা শহীদ হাসপাতালের কাছে একটি তাঁবুতে অবস্থান করছেন তিনি। তাহরির বলেন, আইসিজের রায় শুনেছেন তার স্বামী। শুরুতে তার স্বামী কিছুটা আশাবাদী ছিলেন, কিন্তু এখন আর না। তাহরির বলেন, ‘আমি কিছুতেই আশাবাদী নই। যা ঘটছে তা আমাদের কষ্টের কিছুই পরিবর্তন করবে না। যুদ্ধ, হত্যা এবং ধ্বংস চলতেই থাকবে।’

তাহরির আরও বলেন, ‘আমাদের সাহায্য করার মতো কেউ নেই। কোনো আদালতের সিদ্ধান্ত বা জাতিসংঘের রেজুলেশন—ইসরায়েলকে কেউ আটকাতে পারবে না। যতক্ষণ যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর্থন করবে, ততক্ষণ আমরা কষ্ট পেতেই থাকব। পুরো বিশ্ব আমাদের ধ্বংস হওয়া মেনে নিয়েছে। এটাই সবকিছুর শেষ কথা।’

প্রসঙ্গত, গত প্রায় ৪ মাস ধরে গাজায় বর্বর হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এ হামলায় এখন পর্যন্ত ২৬ হাজার ৮৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও প্রায় সাড়ে ৬৪ হাজার মানুষ। এছাড়া গাজার প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। উদ্বাস্তু হয়েছে ১৯ লাখ বাসিন্দা। বর্তমানে সেখানে দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ করছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

সূত্র: আল জাজিরা, রয়টাস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল