৫১ বছর পর ডলারের রেকর্ড দরপতন

নিজস্ব প্রতিবেদক
আন্তর্জাতিক জার্নাল আন্তর্জাতিক জার্নাল
প্রকাশিত: ০১ জুলাই ২০২৫, ১০:১১ PM

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মার্কিন ডলার আন্তর্জাতিক বাজারে ১০ শতাংশের বেশি দর হারিয়েছে। ১৯৭৩ সালের পর তথা ৫১ বছর পর এটিই সবচেয়ে বড় দরপতন। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র স্বর্ণমান পরিত্যাগ করায় বড় ধস নেমেছিল ডলারের মানে।

তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বিশ্লেষকদের মতে, ডলারের পতনের অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রাসী শুল্কনীতি ও আত্মকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি।

তারা আরও বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্যনীতি, মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা এবং সরকারি ঋণের ঊর্ধ্বগতি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড় ধরিয়েছে। এর ফলে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

ডলার দুর্বল হওয়ায় আমদানির খরচ যেমন বেড়েছে, তেমনি রপ্তানিকারকরা এতে লাভবান হচ্ছেন। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘনঘন শুল্ক আরোপের হুমকিতে বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিস্থিতি অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে। শুরুতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার প্রত্যাশায় ডলার শক্তিশালী হলেও, সেই গতি বেশিদিন টেকেনি।

এর পরিবর্তে শুল্কজনিত মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা, উচ্চ সুদহার এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ ডলারের মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এই প্রসঙ্গে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিশ্লেষক স্টিভ ইংল্যান্ডার বলেন, ডলার শক্তিশালী না দুর্বল সেটা মুখ্য নয়, প্রধান বিষয় হলো বিশ্ব মঞ্চে আপনার অবস্থানকে অন্যরা কীভাবে দেখছে।

২০২৫ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, শেয়ারবাজার ও বন্ডবাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও ডলারের অবমূল্যায়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। বছরের শুরুতে ডলার কিছুটা শক্ত অবস্থানে থাকলেও এখন তা ১৯৭৩ সালের পর সবচেয়ে বড় পতনের মুখে পড়েছে।

পাল্টে যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি
ডলারের মান কমে যাওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ২৪ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু ইউরোয় রূপান্তর করলে লাভ দাঁড়ায় মাত্র ১৫ শতাংশ। এই কারণে অনেক মার্কিন বিনিয়োগকারী ইউরোপসহ অন্যান্য বাজারে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজছেন। ইউরোপের ইউরোস্টক্স ৬০০ সূচক ডলারে হিসাব করলে প্রায় ২৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

বাড়তি ব্যয়, বাড়ছে ঋণ
এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা চলছে। যদিও ট্রাম্প নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ব্যয় কমানোর কথা বলেছিলেন। অনুমান করা হচ্ছে, নতুন বাজেট প্রস্তাব পাস হলে আগামী দশকে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের ঘাটতি তৈরি হবে। সেই ঘাটতি পূরণে সরকারকে ট্রেজারি থেকে বেশি ঋণ নিতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যারা এই ঋণ দেয়, তারাই এখন মার্কিন বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

ডলার দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নিরাপদ মুদ্রা হিসেবে বিবেচিত হলেও বর্তমান অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে সেই আস্থায় ভাটা পড়ছে। বিনিয়োগকারীরা এখন ডলার ও মার্কিন সম্পদের বিকল্প খুঁজছেন। ডলারের ওপর আস্থার এই সংকট আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।

ডিডলারাইজেশন প্রবণতা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ডলারনির্ভর লেনদেন বন্ধ করা এবং সম্পদ জব্দ করা। এই পদক্ষেপ অনেক দেশের কাছে ডলারকে একটি ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহারের উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়। এর ফলে শুরু হয় ‘ডিডলারাইজেশন’ ধারা। অর্থাৎ ডলার বাদ দিয়ে বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনের প্রবণতা।

যদিও এখনো সম্পূর্ণ ডিডলারাইজেশনের বাস্তবায়ন অনেক দূরে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণ এবং আন্তর্জাতিক আস্থার সংকট এই প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করছে এবং দেশটির জন্য তা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস