দ.এশিয়ার প্রথম চিপ ফ্যাক্টরি হতে যাচ্ছে ভারতে

আধুনিক প্রযুক্তির অবিচ্ছেদ্য উপাদান সেমিকনডাক্টর বা চিপ—যা প্রায় প্রতিটি ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ব্যবহৃত হয়। বৈশ্বিক প্রযুক্তি খাত সচল রাখতে এই উপাদানের গুরুত্ব অপরিসীম। চিপ শিল্পকে কেন্দ্র করেই চীন-আমেরিকার মধ্যে অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বও চরমে। এমন প্রেক্ষাপটে এবার দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম সেমিকনডাক্টর ফ্যাক্টরি নির্মিত হতে যাচ্ছে ভারতের গুজরাটে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজ রাজ্য গুজরাটের ধলেরায় নির্মাণাধীন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সেমিকনডাক্টর ফ্যাক্টরিটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ভারতীয় মুদ্রায় ৯৩ হাজার কোটি রুপিরও বেশি। এই বৃহৎ প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে ভারতের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী টাটা গ্রুপ এবং তাইওয়ানের স্বনামধন্য সেমিকনডাক্টর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান পাওয়ারচিপ। অর্থাৎ, এই চিপ ফ্যাবের মূল দুই অংশীদার হলো টাটা গ্রুপ ও পাওয়ারচিপ।
গুজরাটের রাজধানী গান্ধীনগরের দক্ষিণে আড়াই ঘন্টার দূরত্বে অবস্থিত প্রায় ফাঁকা একটি শিল্প এলাকায় (ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে) ধলেরা নামক ‘বিশেষ বিনিয়োগ অঞ্চলে’ গড়ে তোলা হচ্ছে টাটা ও পাওয়ারচিপের যৌথ উদ্যোগে তৈরি চিপ তৈরির ফ্যাক্টরিটি।
প্রকল্পটি ঘিরে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি পরকল্পনা হচ্ছে একটি ‘সেমিকনডাক্টর সিটি’ তৈরি করা যেখানে চিপ সরবরাহকারী একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান থাকবে। ব্যাঙ্গালোর যেমন দেশটির আইটি হাব, তেমনি গুজরাটের ধলেরাকে কেন্দ্র করে একটি সেমিকনডাক্টর হাব তৈরি করতে চাইছে ভারত সরকার।
কোভিডকালীন সময়ে বিশ্বব্যাপী অন্যান্য পণ্যের মতো চিপ সরবরাহও ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। সে সময় চিপ স্বল্পতা প্রকট হয়ে উঠলে জাতীয় ও অর্থনৈতিক সুরক্ষায় চিপের গুরুত্ব অনুধাবন করতে শুরু করে ভারত। ভূ-রাজনীতি ও বিশ্ব অর্থনীতিতে চিপ শিল্পের ভূমিকা ও অবদানের কথা বিবেচনা করেই ২০২১ সালের শেষ দিকে ভারত সরকার স্থানীয়ভাবে চিপ তৈরির উদ্যোগ নেয়। চিপ শিল্পের বিকাশে মোদি সরকার সে বছরই বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রণোদনা বাজেট ঘোষণা করে।
সরকারি প্রণোদনা ঘোষণার পর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও আকর্ষণীয় প্রকল্প হিসেবে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে গুজরাটে নির্মাণাধীন টাটা’র চিপ ফ্যাক্টরিটি। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, চিপ তৈরিতে যতটা সম্ভব স্বনির্ভর হতে চাইছে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটি। এক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদে তাঁদের লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিবেশী চীনের ওপর নির্ভরশীলতা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা।
২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সেমিকনডাক্টর শিল্পের আকার হবে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার, যেটা আজকের তুলনায় দ্বিগুণ। এই প্রেক্ষাপটে ১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারতের বাজারেও যে চিপের চাহিদা উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সে কারণেই সেমিকনডাক্টর শিল্পে সক্ষমতা বাড়াতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ প্রত্যাশা করছে ভারত।
প্রযুক্তি খাতে ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদনে ভারতের অগ্রগতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এক সময়ের সফটওয়্যার-নির্ভর ভারতের প্রযুক্তি খাত এখন ম্যানুফ্যাকচারিংয়েও শক্তিশালী হাব হয়ে উঠছে। চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে আমেরিকান অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে চীনের বিকল্প হিসেবে ভারতকে বিবেচনা করছে।
উল্লেখ্য, অ্যাপলের মোট আইফোন উৎপাদনের এক পঞ্চমাংশ এখন ভারতেই তৈরি হয়। শুধু তাই নয়, বলা হচ্ছে ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ আমেরিকা’তে বিক্রি হওয়া সকল আইফোন ভারত থেকে আমদানি করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে অ্যাপল। প্রযুক্তি খাতে ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন যত বৃদ্ধি পাবে ততই বাড়বে স্থানীয় চিপের চাহিদাও। ফলে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে অগ্রগতি আরও ত্বরান্বিত করতে হলে স্থানীয়ভাবে চিপ তৈরির কোনো বিকল্প দেখছে না ভারত।
গুজরাটে এখন পর্যন্ত পাঁচটি প্রজেক্ট (প্রকল্প) বাস্তবায়নের অনুমতি পেয়েছে। এদের মধ্যে কেবলমাত্র টাটার ফ্যাক্টরি ব্যতীত অন্য ফ্যাসিলিটিগুলোতে মূলত ‘অ্যাসেম্বলি, টেস্টিং ও প্যাকেজিং’ এর কাজ করা হবে। সেমিকনডাক্টর উৎপাদন প্রক্রিয়ার একেবারে শেষ দিকের ধাপ হচ্ছে এটি।
উল্লেখ্য, একেবারে শূন্য থেকে সেমিকনডাক্টর তৈরি করা বেশ জটিল একটি কাজ। সে তুলনায় অন্য কোথাও প্রিন্ট হয়ে আসা চিপগুলোকে আলাদা করে এগুলোকে সুরক্ষা আবরণে মোড়ানোর কাজে জটিলতা অনেক কম এবং এই কাজটি অনেক বেশি শ্রম-নিবিড়। আশা করা যাচ্ছে, চলতি বছরের শেষ নাদাগ ভারতের ফ্যাসিলিটি থেকে ‘প্যাকেজড’ হয়ে আসা প্রথম ব্যাচের চিপ দেখা যাবে। উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামও সাম্প্রতিক সময়ে চিপ উৎপাদনে ব্যাপক আগ্রহ দেখিয়েছে।
গুজরাটে অনুমোদনপ্রাপ্ত অন্য ফ্যাসিলিটিগুলোর তুলনায় ধলেরা’তে নির্মাণাধীন টাটা’র ফ্যাক্টরি বা ফ্যাবের মূল পার্থক্য হচ্ছে, এতে চিপ তৈরি করা হবে একেবারে শূন্য থেকে। অর্থাৎ, চিপ উৎপাদনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজটি করা হবে এই ফ্যাক্টরিটিতে। তাইওয়ানের মতো সবচেয়ে উন্নত চিপ তৈরির সক্ষমতা হয়তো থাকবে না টাটার ফ্যাবে, তবে এখানে উৎপাদিত চিপেরও যথেষ্ট উপযোগিতা থাকবে। এন্ট্রি-লেভেলের স্মার্টফোন থেকে শুরু করে গাড়ি ও আরও কিছু ইলেকট্রনিক পণ্যেও ব্যবহার করা যাবে টাটা’র তৈরি চিপ। টাটা হয়তো তাঁদের তৈরি গাড়িতেই ব্যবহার করতে পারে ধলেরা’তে উৎপাদিত চিপ।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট