কী আছে জুলাই সনদের খসড়ায়?
-1170813.jpg?v=1.1)
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর খসড়ায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে দলীয় প্রধানের দায়িত্বে থাকা যাবে না— এমন বিধানসহ একাধিক প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি কেউ সর্বোচ্চ ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না এবং সংসদকে দুই কক্ষবিশিষ্ট করার সুপারিশও রাখা হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রণীত এই সনদের চূড়ান্ত খসড়া ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পৌঁছেছে। এতে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন–সংক্রান্ত সংস্কারের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে।
ঐকমত্য ও ভিন্নমত
খসড়ায় বলা হয়েছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জোট ও নাগরিকশক্তির সম্মিলিত আলোচনার মাধ্যমে এসব প্রস্তাবে আংশিক ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। তবে কিছু সুপারিশে একাধিক দল আপত্তিও জানিয়েছে।
সনদের ভূমিকায় উল্লেখ করা হয়—১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রতিশ্রুত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গত ৫৩ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। রাষ্ট্রক্ষমতার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ও অপব্যবহারের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়।
এতে আরও বলা হয়েছে, গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান বিকৃতি, দমনমূলক আইন প্রণয়ন, নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনকে দলীয়করণ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের সুযোগ তৈরি করেছে। তবে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে জনগণের আন্দোলনে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা পতনের পর রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনের প্রবল প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে।
রাষ্ট্রভাষা, নাগরিকত্ব ও সংবিধান সংস্কার
খসড়ায় প্রস্তাব করা হয়েছে—
১. প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা।
২. নাগরিকরা পরিচিত হবেন ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে।
৩. সংবিধান সংশোধনে সংসদের দুই কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন লাগবে।
৪. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনে গণভোটের বিধান থাকবে।
৫. অনুচ্ছেদ ৭ (ক) ও ৭ (খ) বিলুপ্ত হবে।
৬. জরুরি অবস্থার ঘোষণা মন্ত্রিসভার অনুমোদন সাপেক্ষে হবে এবং এ বৈঠকে বিরোধী দলের নেতাও উপস্থিত থাকবেন।
৭. জরুরি অবস্থাতেও জীবনের অধিকার ও বিচার-সংক্রান্ত অধিকার খর্ব করা যাবে না।
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার
সংবিধানে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র ও ধর্মীয় স্বাধীনতা-সম্প্রীতি’ রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি যুক্ত হবে—বাংলাদেশ একটি বহু-জাতি, বহু-ধর্মী, বহু-ভাষী ও বহু-সংস্কৃতির দেশ, যেখানে সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও মর্যাদা নিশ্চিত হবে।
মৌলিক অধিকারগুলোর তালিকা সংশোধন ও সম্প্রসারণেরও সুপারিশ করা হয়েছে। তবে পাঁচটি দল মূলনীতির অংশে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবে সংসদের দুই কক্ষের সদস্যদের গোপন ভোটে। প্রার্থী হওয়ার সময় তিনি কোনো সরকারি বা রাজনৈতিক পদে থাকতে পারবেন না।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। তাঁর এখতিয়ারে মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল, আইন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের প্রধান ও সদস্য নিয়োগ অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
রাষ্ট্রপতির অভিশংসনের ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন পেলে তা উচ্চকক্ষে যাবে এবং সেখানেও দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনে প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। ক্ষমা প্রদানের আগে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পরিবারের সম্মতি নেওয়ার বিধানও প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও দলীয় প্রধানের পদ
খসড়ায় বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা
বিদ্যমান সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে যেসব বিধান সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে––
(১) মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্যকোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী নব্বই
(৯০) দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
(২) সংবিধানের ৫৮ (খ) সংশোধনপূর্বক সংসদের মেয়াদ অবসান হওয়ার ১৫ দিন পূর্বে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী পনেরো (১৫) দিনের মধ্যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।
(৩) মেয়াদ অবসানের ক্ষেত্রে সংসদের মেয়াদ অবসান হওয়ার ৩০ দিন পূর্বে জাতীয় সংসদের স্পিকারের তত্ত্বাবধানে এবং সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় — ১. প্রধানমন্ত্রী, ২. বিরোধী দলীয় নেতা, ৩. স্পিকার, ৪. ডেপুটি স্পিকার (বিরোধীদলের) এবং ৫. সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি— (যদি সংসদে আসন সংখ্যার বিবেচনায় একাধিক দল দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের অবস্থানে থাকে তাহলে সেসব দলের মধ্য থেকে নির্বাচনে সর্বোচ্চ পরিমাণে ভোটপ্রাপ্ত দলটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হবে) মোট পাঁচ (৫) সদস্য সমন্বয়ে একটি ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি’ গঠিত হবে। কমিটির যে কোনো বৈঠক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সভাপতিত্ব করবেন স্পিকার।
(৪) কমিটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহ, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের কাছ থেকে সংবিধানের ৫৮গ অনুচ্ছেদে বর্ণিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির নাম প্রস্তাবের আহ্বান করবেন এবং এক্ষেত্রে প্রতিটি দল এক জন এবং একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য একজন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে পারবে।
(৫) রাজনৈতিক দলসমূহ এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যগণ পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদ সচিবালয়ে তাদের প্রস্তাবিত নাম দাখিল করবেন।
(৬) পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কমিটির সদস্যগণ সভায় মিলিত হয়ে নিজেদের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত এবং রাজনৈতিক দলসমূহ ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে প্রস্তাবিত নামসমূহ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করত বাংলাদেশের যে সকল নাগরিক সংবিধানের ৫৮গ অনুচ্ছেদ এর অধীনে উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্য তাদের মধ্য হতে একজনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নেবেন এবং তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন।