রমজানে মিশরীয়রা কেন ‘ফানুস’ জ্বালায়? জানুন হাজার বছরের ইতিহাস
আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফানুস উড়াই, আর মিশরীয়রা ফানুস জ্বালায়। কারণ আরবিতে ‘ফানুস’ অর্থ প্রদীপ বা লণ্ঠন। প্রতিবছর রমজান এলেই মিশরের রাস্তা, দোকান ও বাড়ির বারান্দাগুলো জ্বলে ওঠে বাহারি লণ্ঠনে। মিশরের এই ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরোনো। আজ এই একবিশং শতাব্দীতে এসে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার মাঝেও টিকে আছে মিশরীয়দের লণ্ঠন জ্বালানোর সংস্কৃতি। প্রদীপের মতো টিমটিম করে নয়, বরং দোর্দণ্ড প্রতাপে।
বদলে যায় রাস্তাগুলো
রমজান আসার সঙ্গে সঙ্গেই মিশরের রাস্তাগুলো পুরোনো পোশাক খুলে যেন নতুন পোশাক জড়িয়ে নেয় গায়ে। ধুলো ঝেড়ে জেগে ওঠে নব–উল্লাসে। আপনি যদি রমজানে কায়রো বা অন্য কোনো শহরে যান, দেখবেন, রাস্তার দুই পাশে ঝুলছে বাহারি রঙের ফানুস। ছড়াচ্ছে কোমল নান্দনিক আলো।
শুধু রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলোতেই নয়, বাড়ির বারান্দা ও দোকানের সামনেও দেখতে পাবেন এই ঐতিহ্যবাহী লণ্ঠন বা ফানুস। মিশরে এখন পর্যন্ত যতগুলো পুরোনো আচার–অনুষ্ঠান টিকে আছে, এই ফানুস জ্বালানো তাদের মধ্যে প্রথম সারির। রমজানের শুরুতেই কেউ বাড়ির সামনের প্রধান দরজায় বড় একটি ফানুস ঝুলিয়ে দেয়। সন্ধ্যার পরপর তা জ্বলে উঠে দৃষ্টিনন্দন আলো ছড়ায়। কেউ কেউ ঝুলিয়ে দেয় বাড়ির বেলকনিতে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চর্চিত হয়ে আসছে এই সংস্কৃতি।
ভাষাবিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রিক শব্দ ‘ফ্যানাস’ থেকে ফানুসের উৎপত্তি। পরে যা আরবি শব্দ ভাণ্ডরে প্রবেশ করেছে। এর অর্থ বহনযোগ্য লণ্ঠন, যা থেকে আলো বের হয়।
ফানুস সংস্কৃতির শুরু যেভাবে
ফানুস নিয়ে অনেক প্রচীন গল্প ও মিথ রয়েছে। এর উৎপত্তি কোথায়, তা নিয়ে রয়েছে অনেক মতভেদ। তবে একটি বিষয়ে সব ইতিহাসবেত্তাই একমত যে, মিশরীয়রাই প্রথম ফানুস চিনতে পেরেছিল এবং তারাই আরবের অন্যান্য দেশে ফানুস ছড়িয়ে দিয়েছে।
একটি গল্পে বলা হয়েছে, ৩৫৮ হিজরির রমজান মাসের পঞ্চম দিনে ফাতেমীয় খলিফা আল মুইজ প্রথম কায়রো শহরে প্রবেশ করেছিলেন। ওই দিন খলিফাকে স্বাগত জানাতে হাজার হাজার মিশরীয় নারী–পুরুষ জড়ো হয়েছিল কায়রোর পশ্চিমে বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তরে। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল বলে প্রত্যেকের হাতে ছিল রঙিন লণ্ঠন ও মশাল, যাতে পথ আলোকিত হয়। ধারণা করা হয়, এর পর থেকেই মিশরে আনন্দের প্রতীক ও প্রিয় ঐতিহ্য হয়ে ওঠে রঙিন আলোকজ্জ্বল ফানুস।
অন্য একটি গল্পে শোনা যায়, ফাতেমীয় খলিফাদেরই একজন (তাঁর নাম জানা যায় না) রমজান মাসে পুরো রাত কায়রোর রাস্তা আলোকিত রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি মসজিদের ভেতর আলোকিত করার জন্য ছাদ থেকে ফানুস ঝোলাতে মসজিদের শেখদেরও নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।
তৃতীয় যে গল্পটি প্রচলিত, সেটিও বেশ মজার। বলা হয়, ফাতেমীয় যুগে নারীদের ঘরের বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ ছিল। কোনো প্রয়োজনে তারা যদি রাস্তায় বের হতো, তাহলে তাদের সামনে একজন কিশোর ছেলে লণ্ঠন বহন করত। এর অর্থ হচ্ছে, অন্য পুরুষদের সতর্ক করে দেওয়া যে, ওই লণ্ঠনবাহকের পেছনে একজন নারী রয়েছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের বাইরে বের হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়ে এলেও নারীদের এই ঐতিহ্য মেনে চলতে দেখা যায়। এখন অবশ্য কায়রোর রাস্তায় রাস্তায় শিশুরা ফানুস নিয়ে হাঁটে আর গান গায়।
লণ্ঠন বানায় কারা
ফানুস বা লণ্ঠন জ্বালানোর সংস্কৃতি রমজান মাসে দেখা গেলেও এটি কোনো মৌসুমি শিল্প নয়। সারা বছর ধরেই মিশরীয় কারিগরেরা ফানুস বানাতে থাকে এবং রমজানে বিক্রি করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লন্ঠনের আকার, আকৃতি ও নকশায় পরিবর্তন এসেছে। ধারণা করা হয়, মিশরের অন্যান্য শহরের চেয়ে কায়রো শহরে সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয়েছে ফানুস শিল্পের। তবে আল–আজহার জেলার কাছাকাছি এলাকা যেমন এল দার্ব এল আহমার, আল ঘওরিয়া, সাইদা জেইনাব ও আল ফিল এলাকায় ফানুস তৈরির বহু কারখানা রয়েছে। এসব এলাকায় অনেক পরিবার রয়েছে, যারা বংশ পরম্পরায় ফানুস তৈরি করছে।
মিশরে লণ্ঠনের উৎপত্তি হলেও দ্রুত আশপাশের অঞ্চল যেমন দামেস্ক, আলেপ্পো, জেরুজালেম ও গাজায় ফানুস সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে এবং সেসব অঞ্চলেও ফানুস জ্বালানো ঐতিহ্যে পরিণত হয়।
জেরুজালেমেও প্রচুর ফানুস কারিগর রয়েছে। তারা শক্ত লোহার কাঠামোর মধ্যে কাচ বসিয়ে ফানুস তৈরি করে। আর কাচের গায়ে রঙিন আলপনা আঁকে। রমজান মাসে জেরুজালেমের ওল্ড সিটি মার্কেট ও বাব–আল ওয়াদ সড়কের দোকানগুলোতে এসব ফানুস বিক্রি হতে দেখা যায়। এসব ফানুস খুব উচ্চমূল্যের হলেও জেরুজালেমে এটি বেশ জনপ্রিয়। প্রায় প্রতিটি পরিবার চেষ্টা করে, রমজান মাসে ফানুস জ্বালাতে।
হরেক রকমের লণ্ঠন
প্রাচীন আমলে মিশরীয় পার্লামেন্টের একটি হলে যে ধরনের লণ্ঠন ঝোলানো হয়েছিল, সেটিই এখন পর্যন্ত টিকে থাকা মিশরের সবচেয়ে পুরোনো নকশার লণ্ঠন বলে মনে করা হয়। এই লণ্ঠনটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় লণ্ঠন বা ফানুস। মিশরে এটি পার্লামেন্ট ফানুস নামে পরিচিত।
মিশরে আরেকটি জনপ্রিয় লণ্ঠনের নাম ‘ফারুক ফানুস’। এটি বাদশা ফারুকের নামে নামকরণ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে প্রচলিত গল্পটি হচ্ছে—নিজের জন্মদিন উদযাপনের জন্য রাজা ফারুক তাঁর ভৃত্যদের রাজপ্রসাদ সাজাতে বলতেন। তখন যে বিশেষ ধরনের লণ্ঠন দিয়ে রাজপ্রাসাদ সাজানো হতো, সেটিই পরে ‘ফারুক ফানুস’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
এ ছাড়া ফানুসের ইতিহাসে আবু হাশওয়া, আবু শরফ ও আবু আল ওয়ালাদ ফানুসের নাম পাওয়া যায়। এসব নাম অবশ্য কোনো রাজা–বাদশাহদের নাম নয়। বরং এই ফানুসগুলো পরিচিত হয়ে উঠেছে এদের কারিগরদের নামে। কারণ এই ফানুসগুলো ডিজাইনের দিক থেকে এতটাই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে যে, তাদের নামেই ফানুসগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
মিশরের আরেক শহর আলেকজান্দ্রিয়াতেও প্রচুর ফানুস তৈরির কারখানা রয়েছে। সেখানকার আহমেদ আল সাঈদ নামের এক কারিগর বলেন, ‘আমি লোহা ও কাপড় ব্যবহার করে লণ্ঠন বানাই। আমার লণ্ঠনের নাম ‘খায়ামিয়া’। এটি দেখতে অনেকটা আলাদিনের আশ্চর্য লণ্ঠনের মতো।’
লণ্ঠন তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে আহমেদ আল সাঈদ বলেন, ‘প্রথমে লোহার তার দিয়ে লণ্ঠনের ভেতরের কাঠামো তৈরি করা হয়। এরপর কামারশালায় নিয়ে এটির চরপাশে লোহার বেড় দেওয়া হয়। এরপর বাতি জ্বালানোর জন্য বৈদ্যুতিক মোটর স্থাপন করা হয়। সবশেষে খায়ামিয়া কাপড় দিয়ে লণ্ঠনটিকে ঢেকে দিয়ে দোকানে পাঠানো হয় বিক্রির জন্য।’
এই রমজানেও কায়রো সেজে উঠেছে বহু বর্ণিল ফানুসে। এসব ফানুস কিংবা লণ্ঠন শুধু ঘর আর রাস্তাকেই আলোকিত করে না, বরং হাজার বছরের পুরোনো এক ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার সলতেতেও তেল জোগায়।
সূত্র:ডেইলি নিউজ ইজিপ্ট, আল আরাবিয়্যা, দ্য ন্যাশনাল, আল মাজাল্লা, দ্য ন্যাশনাল নিউজ ও ইজিপশিয়ান স্ট্রিট, গ্লোবাল টাইমস, ইজিপ্ট টুডে