স্থাপত্যকে শুধু দর্শনীয় বস্তুতে রূপান্তর করতে চাননি মাজহারুল ইসলাম
মাজহারুল ইসলাম বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথিতযশা স্থপতিদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বাংলাদেশের স্থাপত্য পেশা চর্চার পথিকৃৎ। বাংলাদেশের স্থাপত্যবিদ্যার শক্ত ভিতটি তৈরি হয়েছে তার হাত ধরে। রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে স্থাপত্যবিদ্যার সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাঁর। ভূমির সঙ্গে সংযোগ আর আকাশ স্পর্শ করার প্রেরণা ছিল তাঁর প্রতিটি কাজে। তিনি স্থাপত্যকে কখনো শুধু শহরকেন্দ্রিক দর্শনীয় বস্তুতে রূপান্তর করতে চাননি।
বাংলাদেশের স্থাপত্য পেশাচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ প্রয়াত স্থপতি মাজহারুল ইসলামের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে উঠে এসেছে এসব কথা।
গতকাল শনিবার (১০ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর বনানীতে বেঙ্গল ইনস্টিটিউটে আয়োজিত আলোচনা সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। স্থাপত্য, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি এই তিনটি পর্বে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বেঙ্গল ইনস্টিটিউট ফর আর্কিটেকচার ও ল্যান্ডস্কেপস অ্যান্ড সেটেলমেন্টের মহাপরিচালক স্থপতি কাজী খালিদ আশরাফ। তিনি পশ্চিম বাংলার বরেণ্য স্থপতি অধ্যাপক সন্তোষ ঘোষের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘মাজহারুল ইসলাম বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্থপতি।’
‘স্থাপত্যমণ্ডল একজন স্থপতির বিবর্তন’ পর্বের আলোচনায় বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, মাজহারুল ইসলাম স্থাপত্যবিদ্যায় একটি ভাষা তৈরি করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আধুনিক স্থাপত্যকে নিজের দেশের সংস্কৃতি, প্রকৃতিকে মাথায় রেখে এনেছেন তিনি।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, মাজহারুল ইসলাম একই সঙ্গে অনেক বিষয়ে বিচরণ করতে পারতেন। তিনি স্থাপত্যকে কখনো শুধু শহরকেন্দ্রিক দর্শনীয় বস্তুতে রূপান্তর করতে চাননি।
এ পর্বের সঞ্চালনার সময় স্থপতি এহসান খান বলেন, মাজহারুল ইসলাম অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সম্পর্ক তৈরি করেছেন। স্থাপত্য দিয়ে সংযোগ তৈরি করেছেন ভূমি থেকে আকাশের সঙ্গে।
স্থপতি মাজহারুল ইসলামের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সভায় বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। ঢাকা, ৯ ডিসেম্বর
স্থপতি মাজহারুল ইসলামের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সভায় বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। ঢাকা, ৯ ডিসেম্বরছবি: দীপু মালাকার
‘রাজনৈতিক মণ্ডল স্থাপত্য ও রাজনীতি প্রসঙ্গে পুনর্ভাবনা’ শীর্ষক দ্বিতীয় পর্বটি সঞ্চালনা করেন কাজী খালিদ আশরাফ।
গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, মাজহারুল ইসলাম আসলে স্থাপত্য, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি তিনটি মণ্ডলেরই। ছায়ানট প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ছিল তাঁর অনেক বড় ভূমিকা। তিনি বলেন, মাজহারুল ইসলাম ছিলেন ওই সময়ে বাম ধারার একজন পৃষ্ঠপোষক। ষাটের দশকে তরুণেরা প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, তা উঠে এসেছিল তাঁর কাজে।
এই পর্বে পারিবারিক সম্পর্কের স্মৃতিকথা উঠে আসে অধ্যাপক নিয়াজ জামানের বক্তব্যে। বিদেশ থেকে গ্রহণ–বর্জন এবং দেশের স্থাপত্যবিদ্যা সম্পর্কে মাজহারুল ইসলামের ব্যক্তিত্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব কতখানি ছিল, সে উদাহরণ দেন তিনি।
স্থপতি নুরুর রহমান খান রাজনীতির সঙ্গে স্থাপত্যের যোগসূত্র তৈরির পেছনে মাজহারুল ইসলামের দর্শন নিয়ে কথা বলেন।
‘সাংস্কৃতিক মণ্ডল চেতনা আন্দোলন’ শীর্ষক তৃতীয় ও শেষ পর্বের সঞ্চালনার সময় স্থপতি সাইফ উল হক বলেন, সমাজের অন্য সবকিছুর সঙ্গেই স্থাপত্য জড়িত। সে ভাবনাটি তৈরি করে দিয়েছেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের বক্তব্যে উঠে আসে সত্তরের দশকে তাঁর চাচা বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের সূত্রে মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে ধানমন্ডিতে প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতি।
মুনতাসীর মামুন বলেন, পঞ্চাশের দশকে দেশের রাজনীতি থেকে শুরু করে শিল্প, সাহিত্য জগতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা। এরই ধারাবাহিকতায় মাজহারুল ইসলাম স্থাপত্যবিদ্যাকে সর্বজনীনভাবে উপস্থাপন করার প্রেরণা পেয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এ ছাড়া বিভিন্ন পর্বে আরও আলোচনা করেছেন স্থপতি খন্দকার হাসিবুল কবির, স্থপতি উত্তম কুমার সাহা ও স্থপতি জালাল আহমেদ।
উল্লেখ্য, মাজহারুল ইসলাম (২৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ - ১৪ জুলাই ২০১২) বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথিতযশা স্থপতিদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বাংলাদেশের স্থাপত্য পেশা চর্চার পথিকৃৎ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই স্থপতি বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রথম সভাপতি ছিলেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণসহ নানা সময়ে বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থেকেছেন তিনি।
কর্মজীবন শুরু করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কনস্ট্রাকশন, বিল্ডিং অ্যান্ড ইরিগেশনে। মতের মিল না হওয়ায় ১৯৬৪ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে ‘বাস্তুকলাবিদ’ নামে একটি স্থাপত্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এ স্থাপত্য অনুষদ চালু করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। এখানে খণ্ডকালীন শিক্ষকতাও করেছেন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ভবন; বিসিএসআইআর লাইব্রেরি ভবন; নিপা ভবন, ঢাকা ( বর্তমানে ভবনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্ট্যাডিজ অনুষদের অফিস ও ই- লাইব্রেরি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে); জীবন বীমা ভবন; রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, সিলেট ও বরিশালের জন্য পাঁচটি পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউট (বিদেশী স্থপতি স্ট্যানলি টাইগারম্যানকে সাথে নিয়ে); রূপপুরে আণবিক শক্তি কমিশনের আবাসন প্রকল্প; জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টার প্লান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবন; জয়পুরহাট কয়লা ও সিমেন্ট প্রকল্প; জাতীয় গ্রন্থাগার ও জাতীয় আর্কাইভ ভবন, শেরে বাংলা নগর; বিশ্ব ব্যাংক অফিস ভবন; ২০ তলা “গার্ডেন সিটি” প্রকল্পসহ আরও অনেক স্থাপত্যে অবদান রাখেন।