ডিসেম্বরে খাদ্যসংকটে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ, মারাত্মক ঝুঁকিতে রোহিঙ্গারা
চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলের প্রায় দেড় কোটি মানুষ মারাত্মক খাদ্যসংকটে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ) এবং জাতিসংঘের তিন সংস্থা। একই সময়ে কক্সবাজার ও ভাসানচরের রোহিঙ্গা শিবিরে গুরুতর খাদ্যসংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যেখানে শরণার্থী জনগোষ্ঠীর চার ভাগের এক ভাগের বেশি মানুষ জরুরি পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন বলে বলা হয়েছে।
গতকাল বুধবার (২৯ অক্টোবর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের চীন–মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ‘ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি)’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), ইউনিসেফ এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। প্রতিবেদনে দেশের ৩৬টি জেলার ৯ কোটি ৬৬ লাখ মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়।
প্রতিবেদনে খাদ্যঝুঁকিকে পাঁচটি ধাপে ভাগ করা হয়েছে—স্বাভাবিক, চাপে থাকা, সংকট, জরুরি অবস্থা ও দুর্ভিক্ষ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কোনো জেলা জরুরি অবস্থায় ছিল না এবং দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতিও দেখা দেয়নি। তবে ডিসেম্বর নাগাদ খাদ্যনিরাপত্তার চতুর্থ ধাপে যেতে পারে কক্সবাজারের উখিয়া–টেকনাফ এলাকা এবং ভাসানচর, যেখানে খাদ্যঘাটতিতে পতিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৩ লাখ ৬০ হাজার ছাড়াতে পারে। এছাড়া স্থানীয় জনগোষ্ঠীরও প্রায় ৩০ শতাংশ বড় ধরণের খাদ্য সংকটে পড়বে বলে অনুমান করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের তুলনায় মে থেকে ডিসেম্বর সময়ে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বাড়বে। জানুয়ারিতে যেখানে ১৬টি জেলায় ১ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ খাদ্যসংকটে ছিল, বছরের শেষ নাগাদ সেই সংখ্যা বেড়ে ১৩টি জেলায় ১ কোটি ৬০ লাখে দাঁড়াতে পারে। বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, বান্দরবান, রাঙামাটি, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ ও কক্সবাজার—এই জেলাগুলোতে সংকট সবচেয়ে ঘনীভূত আকারে দেখা দিতে পারে।
এদিকে খাদ্যসংকটের পাশাপাশি তীব্র অপুষ্টির ঝুঁকিও বাড়ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬ থেকে ৫৯ মাস বয়সী প্রায় ১৬ লাখ শিশু এবং ১ লাখ ১৭ হাজার গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মা অপুষ্টিতে পড়তে পারেন। রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় এ সংখ্যা আরও চিন্তার—৮১ হাজারের বেশি শিশু ও ৫ হাজার মা তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাসুদুল হাসান বলেন, আইপিসির উপস্থাপিত পরিস্থিতির সঙ্গে সরকারের কোনো দ্বিমত নেই। তিনি বলেন, 'খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা আছে, তবে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে তা মোকাবিলায় কাজ করছে।' তাঁর মতে, অর্থনৈতিক চাপ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, সীমিত তহবিল, দুর্বল স্যানিটেশন ব্যবস্থা এবং খাদ্যবৈচিত্র্যের অভাব এই সংকটকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোতে জরুরি সহায়তা পৌঁছানো, পুষ্টিবিষয়ক সেবা বৃদ্ধি, কৃষি ও মৎস্য খাতে প্রযুক্তি ও সহায়তা জোরদার এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ এখন অত্যন্ত প্রয়োজন। ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, 'অপুষ্ট শিশু দেশের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে। এখন শুধু পরিকল্পনা নয়, সবাইকে এগিয়ে এসে দায়িত্ব নিতে হবে।'
ডব্লিউএফপি’র ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর সিমোন পার্চমেন্ট বলেন, 'দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রস্তুতি ও সামাজিক সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।'
অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, এফএওর প্রতিনিধিসহ মানবিক সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন এবং সভাপতিত্ব করেন এফপিএমইউর মহাপরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান।