একটি প্রহর ও মায়াচ্ছন্ন কিছু সত্য

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৪:০২ PM

একটি প্রহর ও মায়াচ্ছন্ন কিছু সত্য

-পৃথিলা দাস

কোচিং এর চাকরি টা চলে যাওয়ায় একটু মন খারাপ আর টেনশনের মধ্য দিয়ে দিনগুলো কাটছিলো। বাসা থেকে যেহেতু নিজের খরচটা নেওয়া হয় না বেশ কিছু বছর ধরে, তাই আবার বাসায় টাকা চাইতে হবে এটা ভেবে নিজের কাছে বেশ লজ্জা লাগছিলো। বাসায় কিভাবে বলবো এটা থেকে শুরু করে আমার ভবিষ্যৎ কি হবে এগুলো শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম। এরমধ্যেই চম্পাকলীর ফোন, রিসিভ করার সাথে সাথেই বলছে :

-পৃথি’পু রাত ১১:৩০ টার মধ্যে রেডি থেকো, আপু তোমাকে ফোন দিবে। আমার তখন মাথার মধ্যে একশোটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল।

-জিগ্যেস করলাম কেন? সে বললো শুভ ভাইয়ের জন্মদিন, মিষ্টি আপু তোমাকে ফোন দিবে। এর বেশি কিছু আমি তোমাকে বলতে পারছি না। বাকিটা আমি বুঝেই নিলাম। শুভ ভাই আর চম্পাকলী তারা একই রুমে থাকে, তাঁরা রুমমেট। আমি বুঝে নিলাম, শুভ ভাইও তার পাশেই আছেন চম্পাকলীও খুব ছোট ছোট স্বরে কথা বলছিলো। চম্পাকলীর নাম কিন্তু চম্পাকলী না, ওটা শুধু আমিই ডাকি, অবশ্য তার একটা মজার ইতিহাস আছে।

যাগগে...

মিষ্টি আপুর ফোনের অপেক্ষা পালা সইল না, আমিই আপুকে ফোন দিলাম। আপুকে ফোন দেওয়ার সাথে সাথে রিসিভ করে মিষ্টি মাখা কন্ঠে বললো,

বোনু এতোরাতে বাসা থেকে বের হতে পারবা তো?

কোনো সমস্যা হবে না তো?

বললাম কোনো সমস্যা হবে না, কোথায় যেতে হবে বলো?

আপু বললো তোমাদের ভাইয়াকে একটু সারপ্রাইজ দিবো, ১১:৩০ টার মধ্যে ভিক্টোরিয়া পার্কে চলে এসো।

আপু আর ভাইয়ার বন্ধুত্বটা এতো সুন্দর, দেখলেই চোখে শান্তি শান্তি একটা ভাব চলে আসে।

 ১১:২০ এর মধ্যে ভিক্টোরিয়াতে পৌঁছালাম। এতো রাতেও জায়গাটা লোকজনের ভিড়ে গমগম করছিলো। এখানে  কেউ গল্প করতে ব্যস্ত, কেউ শরীরচর্চায়, কেউ নিজেকে সময় দিতে ব্যস্ত তবে নিজের ঘুমানোর জায়গা দখল করায় ব্যস্ত লোকজনের সংখ্যা বেশি। যেটা বড্ড মন খারাপ করার মতো একটা বিষয়। এই জায়গাটাতে অনেক সুখ-দুঃখের গল্প আছে। যেদিকেই চোখ ঘুরাই না কেন একটা গল্প খুঁজে পাওয়াই যায়।

এই পার্কের প্রথম পরিচিতি ছিলো ‘আন্টাঘর’ নামে। ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড ক্লাব ছিলো এখানে। তারা এখানে পুল খেলত। স্থানীয়রা ডিমের মতো দেখতে হওয়ায় বলটিকে ‘আন্ডা’ বলে ডাকতো। সে থেকে মাঠটি পরিচিত হয়ে উঠে ‘আন্টাঘর’ নামে। ১৮৫৮ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণের পর এই ময়দানের নাম রাণীর নামানুসারে ভিক্টোরিয়া পার্ক করা হয়। ১৯৫৭ সালে সিপাহী শতবার্ষিকী উপলক্ষে ব্রিটিশদের হাতে মারা যাওয়া সৈনিকদের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মাধ্যমে এর নাম পরিবর্তন করে বাহাদুর শাহ পার্ক রাখা হয়। ব্রিটিশদের হাতে পরাজিত হওয়ায় সর্বশেষ সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এর নাম অনুসারে এ পার্কের নামকরণ করা হয়। তবে এই পার্কটি এখনো জনসাধারনের কাছে ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’ নামেই প্রচলিত আছে।

এই জায়গাতে গেলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। চারপাশে ছোট ছোট বাচ্চা, যাদের কারোর বাবা মায়ের খোঁজ নেই। ক্ষুদার জ¦ালা সহ্য করতে না পেরে নেশা করে পরে থাকে। এই পার্কের ইতিহাস তেমন সুন্দর না, আমার মনে হয়, এই ইতিহাস একটা অভিশাপ দিয়ে গিয়েছে যা এই পার্কটি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে এই ছোট বাচ্চাদের মধ্য দিয়ে। অবশ্য ঢাকা শহরের এই চিত্র নতুন কিছু নয়। এটা এখন সমবেদনার থেকে বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে লোকজনের কাছে।

আপুর ফোন পেয়ে আপুর কাছে চলে গেলাম। হাতে একগুচ্ছ লাল গোলাপ, মোমবাতি, অনেকগুলো গাঁদা ফুল আর ভাইয়ার জন্য কেক নিয়ে আপু, মিশু ভাইয়া, অংকুর দাঁড়িয়ে আছে। চম্পাকলী আসবে ভাইয়াকে নিয়ে। আমরা শুরু করলাম আমাদের কাজ। আমাদের দেখে পার্কের কিছু বাচ্চা এগিয়ে আসলো। তারা খুবই উত্তেজিত, আসলে এখানে কি হচ্ছিলো এটা বোঝার চেষ্ঠা করছে। হাতে কেক দেখে বুঝে গেলো, হয়তো কারোর জন্মদিন। ভাবছিলো একটু হলেও কেকটার স্বাদ নিতে পারবে। আমাদের সাথে তারাও হাত লাগালো।

আমরা সাজিয়ে গুছিয়ে ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আপুর উদ্দীপনা দেখে ভীষণ ভালো লাগছিলো। আমরা নানা রকম কথা বলে আপুর উদ্দীপনা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিলাম। প্রতি মুহুর্ত আপু চিত্ত-চাঞ্চল্যে ভরিয়ে রেখেছিলো। আসলে অপেক্ষার প্রহর যে কত সুন্দর হতে পারে তা আপুকে দেখে উপলব্ধি করতে পারছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার গা ঘেসে পার্কে থাকা ওই বাচ্চাগুলোর মধ্যে একটি বাচ্চা বসে আছে। বয়স এই ৯ বা ১০ হবে। পুরাতন জীর্ণ শীর্ণ একটা সুয়েটার পরে আছে যা প্রায় ওর হাঁটু পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। হয়তো আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছে। আমি তার দিকে তাকাতেই বললো,

journal-poster-(4)-(1)

আফা এখানে কি হইতাছে?

বললাম জন্মদিন।

পাল্টা প্রশ্ন করে বললো কার জন্মদিন? ওই আফার বন্ধুর জন্মদিন?

বললাম দেখতে থাক।

একটু চুপ থেকে আবার বললো, আমারে কি একটু কেক দিবো?

কথাটা খুব মায়া করে বললো।

জিগ্যেস করলাম কোথায় থাকিস? তোর বাবা মা কই?

আমার কথা শুনে ভয় পেলো কিনা বুঝলাম না, আমার কাছে থেকে একটু সরে বসলো। হয়তো কথাটা একটু শক্ত করে বলে ফেলছি। বড্ড বিরক্ত হলাম নিজের প্রতি। মনে মনে বললাম আমকে একটু মিষ্টভাষী হতে হবে। বাচ্চাটাকে ডাকলাম এদিকে আয়, আমার ভাগের কেক টা তোকে দিবো। সে উঠে এসে আমার পাশে বসলো। জিগ্যেস করলাম নাম কি তোর?

বললো, আবু বক্কর।

বললাম কে রাখছে নাম টা?

বললো আব্বা।

তোর আব্বা কই, এটা জিগ্যেস করাতে একটু মন খারাপ হলো। কিন্তু তবুও বললো।

আব্বা আরেকটা বিয়া করছে। এখন সৎমায় ভাত দেয় না। ধইরা মারে।

জিগ্যেস করলাম তোর আব্বা কিছু বলে না তোর সৎমাকে?

বললো আব্বা তাকাইয়া তাকাইয়া দেখে কিছু বলে না। আর সৎমায়ের লগে আব্বা পারেও না। একদিন খুন্তি গরম কইরা পিঠের মধ্যে ছ্যাকা দিছিলো, ওইডা সইহ্য করতে না পাইরা জোরে কান্তা ছিলাম এজন্য লবণ আর মরিচের গুড়া লাগাইয়া দিছে। তখন মনে হইতাছিলো এহনি বুঝি মইরা যাবো।আবার আরেকদিন ঘুমের ভিতরে গলা চাইপা ধরছিলো। এইসব সইহ্য করতে না পাইরা এহানে চইলা আইছি।

এসব শুনে বললাম, তোর আম্মা কই? তোর আম্মার কাছে যা।

বললো আম্মা থাকলে কি আর এইহানে পইরা আছি। আম্মা কবেই মইরা গেছে।

এখানে কতদিন ধরে আছিস?

বললো অনেক দিন হইল আইছি।

আমি জিগ্যেস করলাম, এখানে থাকিস কোথায়? আর কি খাস?

যখন যেইখানে ঘুম পায় সেখানেই ঘুমাই। আমাকে স্মৃতিশৌধ টা দেখিয়ে বললো এইখানেও থাকি। আর মানুষের কাছে চাইয়া যা পাই তাই খাই। 

ওকে জিগ্যেস করলাম নেশা করিস কেন? 

আমার কথা শুনে সাথে সাথে বললো আসতাগফিরুল্লাহ! আমি এগলা করি না।

কিন্তু আমি তো তোকে একটু আগে সিগারেট খেতে দেখলাম।

আমার এই কথাটা শুনে সে একটু ভটকে গেলো। পরে বললো আমি একটু বিড়িই খাই আর কিছু খাই না।

বললাম বিড়ি কেনো খাস?

বললো খিদা কম লাগে।

আমার থেকে কিছুটা দূরে কয়েকজন বাচ্চা একসাথে বসে পলিথিনের মধ্যে মুখ দিয়ে কিসের যেনো গন্ধ নিচ্ছিলো। আবুকে এটা দেখিয়ে বললাম ওরা এগুলো কি করতেছে? তুই কি এগুলো খাস?

আবু বক্কর বললো, এইডা ডেন্ডি খায়তাছে। আমি খাই না আমার গন্ধ লাগে।

জিগ্যেস করলাম ডেন্ডি কী? আর এগুলো কই পাওয়া যায়? কে দেয় ওদের?

আবু বললো, ডেন্ডি হইছে জুতার আঠা। এগলা ১০ টাকা কইরা কিন্না নেয়। কিন্তু কার কাছে কিনে ওইডা আমি জানি না।

আমার এই কথাটা সে আমার থেকে এড়িয়ে গেলো সেটা আমি বুঝতে পারলাম কিন্তু কিছু বললাম না।

আমাদের কথোপকথনের মধ্যেই ভাইয়া আর চম্পাকলী চলে আসলো। আমরা কেক কাটলাম, ছবি তুললাম, ভাইয়াকে শুভকামনা জানালাম। আমি আমার ভাগের কেকটা আবু বক্করকে দিলাম। আবার আপুও তাকে দিয়েছিলো, আমাদের সাথে মোমবাতি জ্বালানোর বকশিশ হিসেবে। পার্কে থাকা বাকি বাচ্চাগুলোকেও অবশ্য একটু একটু করে কেক দেওয়া হয়েছিলো। দুই পিস কেক পেয়ে আবু বক্করের চোখ খুশিতে জ¦ল জ¦ল করছিলো। সে দৃশ্য আমি তাকিয়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম আমাদের সুখ কোথায় নিহীত থাকে? আমরা কি পেলে সন্তুষ্ট হবো? কেক আমার ভীষণ পচ্ছন্দের কিন্তু এই এক পিস কেক আবু বক্করকে দেওয়ার পর আমার যে মানসিক শান্তি অনুভ‚ত হচ্ছিলো সেটা কি কেক টা খাওয়ার পর হতো? আমার ভীষণ মায়ের কথা মনে পড়ছিল। মা-বাবা আমাদের জীবনে চিরন্তন সত্য। উনারা ছাড়া আমাদের জীবন সহজ, সুন্দর ও সজীব কখনোই হবে না। একটা মুহুর্তের জন্য নিজেকে আবু বক্করের জায়গায় চিন্তা করলাম। আমি বেশিক্ষণ ভাবতে পারিনি কেন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। আবু বক্করের বাবার জায়গায় আমার বাবাকে কল্পনা করলাম, কিন্তু আমি ভাবতে পারছিলাম না আমার মৃত্যু যন্ত্রণার মতো মনে হচ্ছিলো। অন্যদিকে, মিষ্টিআপু আর ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিলো, এমন ভালোবাসামিশ্রিত বন্ধুত্ব টাও প্রয়োজন। আহা পৃথিবাটা বিচিত্রময়।

 সেদিনের মতো আমাদের প্রোগ্রাম শেষে বাসায় ফিরে, একমুহুর্ত দেরি না করে বাবাকে ফোন দিয়েছিলাম। এতো রাতে আমার ফোন পেয়ে বাবা-মা দুজনেই প্রচÐ বিচলিত হয়ে পরেছিলো। তাদের শান্ত করে বললাম, তোমাদের কথা ভীষণ মনে পরছিলো। বাবাকে বললাম, বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসি। বাবার সাথে আমার সম্পর্ক কখনোই সহজ ছিলো না। বাবাকে ভীষণ ভয় পাই আমি। বাবা আমার কথা শুনে হেসে বললেন, আমি জানি মা। আমিও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।

মা ফোনটা নিয়ে বললো, কোচিং এ কোনো সমস্যা হয়েছে?

বললাম, পরের মাস থেকে টাকা পাঠিও।

এটা শোনার পর মা, জোরে হেসে বললো এটা বলার জন্য এতোকিছু ভাবতে হয়?

জিগ্যেস করলাম, কি করে বুঝলা আমার কোচিং এ সমস্যা হয়েছে?

মা শুধু বললো, আমি তোর পেট থেকে হইনি, তুই আমার পেট থেকে হইছিস।

সেদিন খুব প্রশান্তি নিয়ে বিছানায় গেলাম ঘুমাতে। মনে হলো, মাথা থেকে প্রচÐ ভারি এক পাহাড় নেমে গেলো।

আমাদের জীবন ভয়ংকর সুন্দর।