ছুটিতে আপনার গন্তব্যস্থল হতে পারে নীল জলরাশির দ্বীপ সেন্টমার্টিনে

নিজস্ব প্রতিবেদক
জার্নাল ডেস্ক জার্নাল ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৩২ AM

বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। এটি বাংলাদেশের মূলভূখন্ডের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত। কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে ১৭ বর্গ  কিলোমিটারের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ সেন্টমার্টিন। সেন্ট মার্টিনে নারিকেল গাছের সংখ্যা বেশি জন্য স্থানীয় ভাষায় নারিকেল জিঞ্জিরা বলেও ডাকা হয়। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত এ দ্বীপটি বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন স্থান হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে। অসীম নীল আকাশের সাথে সমুদ্রের নীল জলের মিতালী, সারি সারি নারিকেল গাছ এ দ্বীপকে করেছে অনন্যা, যা ভ্রমণ পিয়াসী মানুষকে দুর্নিবার আকর্ষণে কাছে টেনে নেয়।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বিচ (ছবি: সিটিজেন জার্নাল)
 
প্রথম কবে এই দ্বীপটিকে মানুষ শনাক্ত করেছিল তা জানা যায় না। তবে প্রথম কিছু আরব বণিক এই দ্বীপটির নামকরণ করেছিল জিঞ্জিরা। উল্লেখ্য, এরা চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যাতায়াতের সময় এই দ্বীপটিকে বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করতো। কালক্রমে চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন মানুষ এই দ্বীপটিকে জিঞ্জিরা নামেই চিনতো। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কিছু বাঙালি এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ এই দ্বীপে বসতি স্থাপনের জন্য আসে। এরা ছিল মূলত মৎস্যজীবী। যতটুকু জানা যায়, প্রথম অধিবাসী হিসাবে বসতি স্থাপন করেছিল ১৩টি পরিবার। এরা বেছে নিয়েছিল এই দ্বীপের উত্তরাংশ। কালক্রমে এই দ্বীপটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়। আগে থেকেই এই দ্বীপে কেয়া এবং ঝাউগাছ ছিল। সম্ভবত বাঙালি জেলেরা জলকষ্ট এবং ক্লান্তি দূরীকরণের অবলম্বন হিসাবে প্রচুর পরিমাণ নারকেল গাছ এই দ্বীপে রোপণ করেছিল। কালক্রমে পুরো দ্বীপটি একসময় 'নারকেল গাছ প্রধান' দ্বীপে পরিণত হয়। এই সূত্রে স্থানীয় অধিবাসীরা এই দ্বীপের উত্তরাংশকে নারিকেল জিঞ্জিরা নামে অভিহিত করা শুরু করে। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জরিপ দল এই দ্বীপকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসাবে গ্রহণ করে। জরিপে এরা স্থানীয় নামের পরিবর্তে একজন খ্রিষ্টান সেন্ট মার্টিনের নামানুসারে সেন্ট মার্টিন নাম প্রদান করে। এরপর ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের বাইরের মানুষের কাছে, দ্বীপটি সেন্ট মার্টিন নামেই পরিচিতি লাভ করে।[৩] চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শেখ বখতিয়ার উদ্দিন এর মতে, ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে দ্বীপটিকে যখন ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মার্টিনের নাম অনুসারে দ্বীপটির নামকরণ করা হয়। 

নারিকেল জিঞ্জিরা (ছবি: সিটিজেন জার্নাল)

শীতের শুরুতে অথবা সরকারি ছুটিতে কিংবা ভ্রমণে আপনার গন্তব্যস্থল হতে পারে নীলাভ জলরাশির মনোমুগ্ধকর দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে।

জাহাজে সেন্টমার্টিনে যাওয়ার সময় দেখতে পাবেন এমন মনোরম দৃশ্য (ছবি: সিটিজেন জার্নাল)

সেন্টমার্টিন যাওয়ার উপায়
সেন্টমার্টিন যাবার বেশিরভাগ শীপ টেকনাফ থেকে ছেড়ে যায়। তাই সেন্টমার্টিন যেতে চাইলে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ চলে যাওয়া সুবিধাজনক। টেকনাফ থেকে জাহাজে অথবা ট্রলারে করে সেন্টমার্টিন যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে যেতে চাইলে সরাসরি বাসে টেকনাফ গিয়ে সেখান থেকে জাহাজে/ট্রলারে করে সেন্টমার্টিন যাওয়া সুবিধাজনক। কক্সবাজার ভ্রমণ পরিকল্পনায় থাকলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার হয়ে তারপর টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যেতে পারবেন। অথবা কক্সবাজার থেকে এমভি কর্ণফুলী এক্সপ্রেস শীপে সরাসরি সেন্টমার্টিন যেতে পারবেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকেও সেন্টমার্টিন যাবার এমভি বে ওয়ান শীপ চালু হয়েছে। সেন্টমার্টিন যাওয়ার সাম্ভাব্য সকল উপায় নিচে বিস্তারিত দেওয়া হলো।

জাহাজ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পদার্পন (ছবি: সিটিজেন জার্নাল)

ঢাকা থেকে টেকনাফ যাবার উপায়
ঢাকা থেকে বাসে করে সরাসরি টেকনাফে যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী, কলাবাগান, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ ও আবদুল্লাহপুর থেকে শ্যামলী, সেন্টমার্টিন পরিবহন, সেন্টমার্টিন হুন্দাই, রয়েল কোচ, তুবা লাইন, এস আলম, মডার্ন লাইন, গ্রীন লাইন ইত্যাদি বাস সরাসরি টেকনাফ যায়। ভাড়া সাধারণত বাস ও ক্লাস অনুযায়ী ১০৫০ থেকে ২২০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। যদি শুধু সেন্টমার্টিন যেতে চান তাহলে ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে টেকনাফ চলে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো। রাত ৮-১০ টার মধ্যে বাস রওনা দিয়ে সকাল ৮টার মধ্যে টেকনাফ পৌঁছে যায়।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ (ছবি: সিটিজেন জার্নাল)

কক্সবাজার হয়ে টেকনাফ যাবার উপায়
ঢাকা থেকে প্রথমে কক্সবাজার এসে তারপর কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে পারবেন। ঢাকা থেকে প্রতিদিনই গ্রীন লাইন, সোহাগ, টিআর ট্রাভেলস, শ্যামলী, হানিফ, সৌদিয়া, ঈগল, এস আলম, সিল্ক লাইন, সেন্টমার্টিন ইত্যাদি অনেক বাস কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। বাস ভেদে ভাড়া সাধারণত ৯০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকার মধ্যে। এছাড়াও ঢাকা থেকে বিমানে সরাসরি কক্সবাজার যাওয়া যায়।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপে

কক্সবাজার থেকে টেকনাফ : কক্সবাজার থেকে লোকাল বাস/মাইক্রো/জিপ/সিএনজি ভাড়া করে টেকনাফ যাওয়া যায়। কক্সবাজার হতে টেকনাফ যাওয়ার বাস ভাড়া ১৫০ টাকা ও সিএনজি ভাড়া জনপ্রতি ২৫০ টাকা। টেকনাফ যেতে অবস্থা ভেদে সময় লাগে প্রায় দুই ঘন্টা। আর সকালের জাহাজ ধরতে চাইলে কক্সবাজার থেকে ভোরে (৬টার মধ্যে) টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে ।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ছোট শিপ (ছবি: সিটিজেন জার্নাল)

চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ যাবার উপায়
চট্টগ্রামের সিনেমা প্যালেস থেকে এস আলম এবং সৌদিয়া বাস রাত ১২ টায় টেকনাফের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এছাড়া জিএসই গরিবুল্লাশাহ মাজার ও দামপাড়া থেকেও কিছু বাস চট্টগ্রাম-টেকনাফ রুটে চলাচল করে। চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ বাসে যেতে খরচ হবে ৫৫০-১২০০ টাকা।

সেন্ট মার্টিন

টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাবার উপায়
সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে প্রতিদিন বেশ কয়েকটি জাহাজ/শীপ আসা যাওয়া করে। টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে চলাচলকারী শীপের মধ্যে আছে কেয়ারী সিন্দাবাদ, কেয়ারি ক্রজ এন্ড ডাইন, এম ভি ফারহান, আটলান্টিক ইত্যাদ। জাহাজে করে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা থেকে আড়াই ঘন্টা।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ

জাহাজের ক্লাস ও মান অনুযায়ী সেন্টমার্টিন যাওয়া ও আসার টিকেট ভাড়া ৮৫০ থেকে ১৬০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। টেকনাফ জেটি ঘাট থেকে প্রতিদিন জাহাজগুলো সকাল ৯.০০-৯.৩০ মিনিটে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সেন্টমার্টিন থেকে ফেরত আসে বিকাল ৩.০০-৩.৩০ মিনিটে। সেন্টমার্টিন যাওয়ার শীপের টিকেট সাধাণত যাওয়া ও আসা সহ হয়ে থাকে। টিকেট করার সময় কবে ফিরবেন তা উল্লেখ করতে হবে।

সেন্ট মার্টিনে সমুদ্রের ঢেউ

সধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ/এপ্রিল এই পাঁচ মাস জাহাজ চলে। অন্য সময়ে গেলে ট্রলার কিংবা স্পিডবোট দিয়ে যেতে হবে। শীত মৌসূম ছাড়া বাকি সময় সাগর উত্তাল থাকে, তাই এই সময়ে ভ্রমণ নিরাপদ নয়। টেকনাফ নামারবাজার ব্রিজ বা জেটি ঘাট থেকে ট্রলার, স্পিডবোট ও মালবাহী ট্রলার ছাড়ে। ট্রলারে সেন্টমার্টিন যাবার ভাড়া ২৫০-৩৫০ টাকা। এটা সিজন ও যাত্রীভেদে কম বেশি হয়ে থাকে। সময় লাগে প্রায় ৩ ঘন্টা। ট্রলারে বা স্পিডবোটে গেলে অনেক রোলিং হয়, তাই শীপে যাওয়াটাই ভালো উপায়।

শৈবাল

সেন্টমার্টিন দ্বীপের বিখ্যাত খাবার
ডাবঃ ডাব হলো এই দ্বীপের বিখ্যাত খাবার গুলো ভিতরে অন্যতম। এখান কার ডাব এতটাই সু-স্বাদু আপনি খেলে জানতে পারবেন না। আপনি যদি এখানে ভ্রমণ করতে আসেন আশা করি ডাব খেতে কখনও ভূলবেন না।

সেন্ট মার্টিনের বিখ্যাত খাবার (ছবি: সিটিজেন জার্নাল) 

ডাব ছাড়াও এখানে বাহারি রকমের খাবার রয়েছে যা খুবই সুস্বাদু এবং টেস্টি একবার খেলে মনে হবে বারবার খাই। সুস্বাদু খাবার গুলোর ভিতরে রয়েছে ইলিশ, কালাচাঁদ, রবস্টার, কোরাল, সুন্দরী পোয়া মাছের বাহারি স্বাদের খাবার। আপনি আরো একটি খাবার খেতে পারেন সেটা হলো মুরগীর কোরা। এছাড়াও এই দ্বীপটিতে আরোও ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের খাবার রয়েছে যা খেতে দেখতে পারেন।

সেন্টমার্টিন দ্বীপটির দর্শনীয় স্থান
১. ছেড়া দ্বীপ
২. সারি সারি নারকেল গাছ
৩. কোরাল দ্বীপ
৪. রাস্তার পাশে থাকা সুন্দর সুন্দর রিসোর্টসমুহ

৫. জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদের বাড়ি

৬. মিনি সুন্দরবন

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ (ছবি: সিটিজেন জার্নাল)

ভ্রমণ টিপস ও সতর্কতা
সেন্টমার্টিন আমাদের দেশের সম্পদ, তাই প্রকৃতির ক্ষতি হয়ে এমন কিছু করবেন না।
সেন্টমার্টিনে মোবাইল ফ্রিকোয়েন্সি কম থাকে। কথা বলতে সমস্যা হতে পারে। তবে টেলিটক তুলনামূলক ভাল কাজ করে।
বর্তমানে নিয়মিতভাবে সেন্টমার্টিনে বিজিবি টহল দেয়৷ তারা অনেক সময় রাত ১২টার পর পর্যটকদেরকে বীচ বা জেটি এলাকায় থাকতে নিষেধ করে।
সঠিক জায়গায় ময়লা আবর্জনা ফেলবেন। দয়া করে প্লাস্টিক/পলিথিন কিছু সৈকতে ফেলে আসবেন না।
কম খরচে সেন্টমার্টিন থাকা ও খাওয়ার জন্যে ছুটির দিন গুলোতে না গিয়ে অন্যান্য দিনে যেতে পারেন।
বর্তমানে সেন্টমার্টিনে অনেক হোটেল ও কটেজ গড়ে উঠেছে, থাকার জায়গায়র অভাব তেমন হয় না।
পর্যটন এলাকায় যে কোন কিছুর জন্যে দরদাম করবেন কেনাকাটায়।
মানুষ বেশি হলে আগেই শিপের টিকেট কেটে রাখতে পারেন।
দালালদের খপ্পরে পড়বেন না। নিজেই সবকিছু করুন।
চাইলে কক্সবাজার বিভিন্ন এজেন্ট থেকে সেন্টমার্টিন এর প্যাকেজ কিনে নিতে পারবেন।
সেন্ট মার্টিন যাওয়া আসার সময় জাহাজের ডেক থেকেই সবচেয়ে সুন্দর ভিউ দেখতে পাবেন।
সমুদ্রে নামার সময় সতর্ক থাকুন।