১৯৬৫ সালের পর আবার চালু হচ্ছে রাজশাহী-মুর্শিদাবাদ নৌপথ
ছয় দশক পর চালু হচ্ছে রাজশাহীর সঙ্গে ভারতের মুর্শিদাবাদের নৌপথে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। আগামীকাল সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ নদীবন্দর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্দরটি চালু হলে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও গতিশীল হওয়া ছাড়াও কমবে আমদানি-রপ্তানি ব্যয়।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগ পর্যন্ত রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ থেকে ভারতের মুর্শিদাবাদের ময়া নৌঘাট দিয়ে নৌপথে রমরমা বাণিজ্য ছিল। পরে অবশ্য বন্ধ হয়ে যায় নৌপথটি।
দীর্ঘ ৫৯ বছর পর দুই দেশের সমঝোতায় ফের চালু হচ্ছে নৌপথ। নৌ-প্রটোকল চুক্তির আওতায় সচল হচ্ছে সুলতানগঞ্জ নদী বন্দর।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৫৮ বছর আগে এ পথে বাংলাদেশ-ভারতে পণ্য আনা-নেয়া বন্ধ হয়। এর পর থেকে পণ্য আনা-নেয়া হতো সড়ক ও রেলপথে। এতে উভয় দেশের পণ্য পরিবহন খরচ বেশি হতো। সুলতানগঞ্জ নৌবন্দরের মাধ্যমে ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে সময় ও খরচ দুটোই কমবে। এতে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, বছরে এ নৌপথে দুই দেশের মধ্যে হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হবে।
এর আগে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভায় সিদ্ধান্ত হয় সুলতানগঞ্জ আর পশ্চিমবঙ্গের ধুলিয়ান নৌরুটে বাণিজ্য চালুর। রাজশাহী থেকে মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার একটি নৌপথের অনুমোদন থাকলেও পদ্মার নাব্যতা সংকটের কারণে কার্যকর করা যায়নি। ফলে রুটটি সুলতানগঞ্জ থেকে ময়া নৌবন্দর পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত করা হয়। আড়াআড়িভাবে ২০ কিলোমিটার পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে পণ্য আনা-নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। শুরুতে এ নৌপথে ভারত থেকে পাথর, বালি ও বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী আনা হবে।
গত বৃহস্পতিবার সরজমিনে সুলতানগঞ্জ ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, নৌবন্দর তৈরির লক্ষ্যে কাজ চলছে। পণ্য আনা-নেয়ার জন্য তৈরি করা হচ্ছে রাস্তা। পন্টুন তৈরির কাজও শেষের দিকে। পাশে রাখা হয়েছে বিশাল আকৃতির একটি ট্রলার। এ ট্রলার দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ভারতে পণ্য পাঠানোর কথা রয়েছে। ঘাটের পাশে রাখা আছে সারি সারি ইট। পলি মাটিতে এ ইট দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হবে।
সুলতানগঞ্জ ঘাটে কাজের তদারকি করছিলেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) উপসহকারী প্রকৌশলী মো. শাহ আলম। তিনি জানান, দ্রুতগতিতে কাজ চলছে। আগামী সোমবার এ নৌবন্দর উদ্বোধন করা হবে। এখানে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় নতুন প্রকল্প নেবে। প্রথমে জমি অধিগ্রহণ করা হবে। সরাসরি মহাসড়কের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে। এ নৌরুটে নাব্যতা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। এখানে অনেক পানি আছে। পণ্য পরিবহন শুরু হলে চর আর থাকবে না, ড্রেজিং করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সুলতানগঞ্জ থেকে ময়া নৌঘাটের নদীপথে দূরত্ব মাত্র ১৭ কিলোমিটার। সুলতানগঞ্জ নৌ-ঘাটটি রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণের পদ্মার শাখানদী মহানন্দার মোহনার কাছাকাছি। সারা বছর সুলতানগঞ্জের এ পয়েন্টে পানি থাকে। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের ময়া নৌঘাটটি মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুর মহকুমা শহরের কাছে ভারতীয় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের সঙ্গে যুক্ত। ফলে সুলতানগঞ্জ-ময়া পথে নৌবাণিজ্য শুরু হলে পরিবহন খরচ অনেকাংশে কমে যাবে।
এ নৌবন্দর চালু হলে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। স্থানীয় বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান জানান, এক সময় এখানে নৌবন্দর ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের ছয় বছর আগে এ বন্দর বন্ধ হয়ে যায়। চালু থাকা অবস্থায় বিশাল বিশাল জাহাজ আসত এখানে। সুলতানগঞ্জ ঘাটের পশ্চিম দিকে বিশাল ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে এ বন্দর করলে আরো ভালো হতো। সেখানে সরকারি খাস জায়গা পড়ে আছে। আর কিছুদূর পরই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শুরু। সেখান থেকেও সরাসরি সড়কে ওঠা যাবে।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান আরিফ আহমেদ মোস্তফা বলেন, ‘সুলতানগঞ্জ-ময়া একটি লাভজনক ও চমৎকার নৌরুট হতে পারে। দুই পাড়েই অবকাঠামোগত কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে সুলতানগঞ্জ বন্দর চালু হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে সেগুলো ঠিক করা হবে। ভারত ময়া ঘাটও প্রস্তুত করেছে। উদ্বোধন হলে পণ্য পরিবহন শুরু হবে।’
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘মুর্শিদাবাদের ধূলিয়ান থেকে গোদাগাড়ীর সুলতানগঞ্জ, রাজশাহী, পাকশী হয়ে আরিচাঘাট পর্যন্ত এ নৌরুটটি। দীর্ঘদিন এটির ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ ছিল না। আমি গত পাঁচ বছর বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া, লেখালেখি ও ডিও লেটার দিয়েছি। ফলে এটা গতিশীল হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ উভয়পক্ষ বিশেষ করে ভারত নৌপথে বাণিজ্য করতে আগ্রহী। বাংলাদেশ হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের সাতটি প্রদেশ আছে, সেগুলোতে সুলভে মালামাল পৌঁছে দিতে তারা নৌপথে বাণিজ্য করতে চায়।’
তিনি জানান, পাঁচটি নৌযানের মাধ্যমে ট্রায়াল দেয়া হবে। বর্ষাকালে দুই থেকে আড়াই হাজার টন কার্গো যাতায়াত করতে পারবে। আর খরা মৌসুমে সেটি ৭০০ থেকে ৮০০ টনে দাঁড়াবে। এ নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ যথেষ্ট আগ্রহী ও আন্তরিক। ফলে রাজশাহী-নবাবগঞ্জ অঞ্চলের মানুষ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, ‘ভারত থেকে লাখ লাখ টন পাথর বাংলাদেশে আনতে হয় সড়কপথে ও ট্রেনে করে। এতে খরচও বেশি হয়। নৌপথে পাথর আনতে পারলে খরচ অনেক কমে যাবে। পাশাপাশি এ নৌরুটটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।’