বিশ্ব মেডিটেশন দিবস
শিক্ষার্থীদের হতাশা প্রতিরোধে মেডিটেশন আর ব্যায়াম প্রয়োজন
আজ ২১ মে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্ম*হত্যার প্রবণতা কি মহামারির দিকে যাচ্ছে? জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ভিকারুন্নেসা স্কুল এন্ড কলেজসহ দেশের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্ম*হত্যার ঘটাগুলো এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হতে না পেরে বহু শিক্ষার্থী হতাশায় ভোগে, সে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই এখন আত্মহত্যা করছে। কি অদ্ভুত বাস্তবতা!
বাংলাদেশে আত্মহত্যা নিয়ে জরিপ করে এরকম একটি সংগঠনের নাম হচ্ছে আঁচল ফাউন্ডেশন। তাদের জরিপে দেখা গেছে— কোভিড সংক্রমণের প্রথম ১২ মাসে (মার্চ ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত) দেশে আত্মহত্যা করেছে সাড়ে ১৪ হাজার, যার বেশিরভাগ কিশোর ও তরুণ। ২০২৩ সালে ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে, যাদের বেশিরভাগ (৬৫.৫%) হচ্ছে ১৩-১৯ বছর বয়সী, ৪৪.২০%, স্কুল শিক্ষার্থী। পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি।
আচঁল ফাউন্ডেশনের ২০২৩ সালের জরিপ অনুসারে, ২৮.৮% শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন অভিমানে, ১৬.৫% প্রেম-ঘটিত কারণে, ৮.৪% মানসিক ভারসাম্যহীনতায়, ৭.১% পারিবারিক কলহে, ৩.৯% যৌন হয়রানি, ৪.৫% পড়াশোনার চাপ ও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে।
আরও সহজ করে বললে শিক্ষার্থী আত্মহত্যার ঘটনাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইমপালসিভ বা ঝোঁকের বশে অথবা অনিয়ন্ত্রিত আবেগের ফলাফল। পরিবারের কেউ বকাঝকা বা তিরস্কার করলে, পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে, বিশেষ লক্ষ্য বা স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয়ে, প্রেমে ব্যর্থতা বা সম্পর্কে টানাপোড়ন হলে অভিমান বা আবেগের বশবর্তী হয়ে শিক্ষার্থীরা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিশোর-কিশোরীরা এটাকেই মুক্তির উপায় মনে করে।
আমরা এমন একটি সময়ে বাস করছি, যেখানে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের জীবন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। একদিকে হরমোন-জনিত শারীরিক-মানসিক নানা প্রতিকূলতা, অন্যদিকে সামাজিক বাস্তবতার চাপ। পারিবারিক প্রত্যাশা, পড়াশোনার চাপ, পরীক্ষায় ব্যর্থতা, ভার্চুয়াল আসক্তি, ইভটিজিং, বুলিং, যৌন হয়রানি, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি কারণে যে মানসিক চাপ তৈরি হয় সেটা প্রশমনের জায়গা কোথায়?
খেলাধুলার জায়গা নেই, নেই সংস্কৃতি কর্মকাণ্ড, নেই কোনও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ— তাহলে তারা কী করবে? ফলাফল হচ্ছে হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া, পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া, বখে যাওয়া, নৈতিক অধঃপতন, মাদকাসক্ত হওয়া, সহিংসতা, কিশোর গ্যাং সহ নানা ধরনের সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া। আরেকটি অংশ বেছে নেয় আত্মহননের পথ।
বিশেষজ্ঞরা এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলিং সেবা চালু করার কথা বলেছেন। এটি নিঃসন্দেহে ভালো পরামর্শ। কিন্তু কাউন্সেলিং সেবা দেয়ার জন্য মনস্তত্ত্বের উপর বিশেষ ধরনের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক পারদর্শিতার প্রয়োজন হয়। ইচ্ছে করলেই, যে-কেউ এই সেবা দিতে পারেন না। এর জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। তাই বর্তমান বাস্তবতায় সীমিত জনবল, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও বাজেট দিয়ে প্রতিটি স্কুলে কাউন্সেলিং সেবা চালু করা সম্ভব নয়। বড়জোর হাতেগোনা কিছু স্কুলে করা যেতে পারে।
তাই বলে আমাদের কি কিছুই করার নেই। অবশ্যই আছে। এমন কিছু করতে হবে যা শিক্ষার্থীদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট রাখবে, আবেগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে, যাতে তারা নিজেরাই যেকোনো প্রতিকূলতা মোকাবিলার সামর্থ্য অর্জন করতে পারে।
এখানেই ধ্যান ও যোগ ব্যায়ামের প্রাসঙ্গিকতা। এর সুবিধে হচ্ছে, খুব অল্প সময়ে কম খরচে অসংখ্য শিক্ষার্থীদেরকে শেখানো সম্ভব। শুধু প্রয়োজন হবে ক্লাস শুরুর আগে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার্থীদের ২০-৩০ মিনিট ধ্যান ও যোগব্যায়ামের বিভিন্ন কলাকৌশল চর্চা করার সুযোগ করে দেওয়া। শিক্ষকদের শিখিয়ে দিলে, তারাই ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে শিক্ষার্থীদের পরিচালনা করতে পারবে।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে ধ্যান ও যোগব্যায়াম নিয়ে অসংখ্য গবেষণা হয়েছে। ফলাফল হচ্ছে— ধ্যান ও যোগব্যায়াম করলে পড়াশোনায় মনোযোগ বৃদ্ধি পায়, ব্রেনের কার্যক্ষমতা বাড়ে, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়, চালচলনে স্থিরতা আসে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বাড়ে, ধৈর্য্যশক্তি বাড়ে, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ইত্যাদি। নিয়মিত মেডিটেশনে হতাশা দূর হয়, মানসিক চাপ প্রশমিত হয়, আত্মহত্যার প্রবণতা হ্রাস পায়।
এসব উপকারিতার কথা চিন্তা করেই এমআইটি, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, ইয়েল, স্ট্যানফোর্ডসহ বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা ধরনের কোর্স চালু করেছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে— শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচকতা সঞ্চারিত করা, হতাশা ও বিষণ্ণতা থেকে মুক্ত করা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, পড়াশোনায় সাফল্য, মনোযোগ বৃদ্ধি এবং মনোদৈহিক সুস্থতা। এসব কোর্সে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদানের পাশাপাশি মেডিটেশন, দমচর্চা এবং যোগব্যায়ামের বিভিন্ন কলাকৌশল শেখানো হয়।
বসে নেই আমাদের প্রতিবেশ দেশও। দিল্লির আম আদমি সরকার ২০১৮ সালে তাদের স্কুল কারিকুলামে ‘হ্যাপিনেস’ নামে নতুন একটি বিষয় যুক্ত করেছেন। এই হ্যাপিনেস কারিকুলামের অধীনে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন ৪৫ মিনিটের একটি ক্লাস করবে, যেখানে ধ্যান ও যোগ ব্যায়াম শেখানো হবে। ২০২০ সালে পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকার কোভিডকালীন ক্ষতি পোষাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধ্যান ও যোগব্যায়াম চর্চার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন।
সারা পৃথিবী যখন তরুণ প্রজন্মকে ধ্যান ও যোগ ব্যায়ামে উদ্বুদ্ধ করার জন্য নানা কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে, তখন আমরা কেন বসে আছি? আশাকরি অর্থ মন্ত্রণালয়, রাজস্ব বিভাগ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহ সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের সকল ব্যক্তিবর্গ এই বিষয়টিতে বিশেষ মনোযোগ দিবেন। অন্তত ক্রমবর্ধমান এই তরুণ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য হলেও মেডিটেশন উৎসাহিত করার পদক্ষেপ নিন। সবাইকে বিশ্ব মেডিটেশন দিবসের শুভেচ্ছা।