দেশে চালু হল স্টারলিংক, যত টাকায় মিলবে সেবা

নিজস্ব প্রতিবেদক
জার্নাল ডেস্ক জার্নাল ডেস্ক
প্রকাশিত: ২০ মে ২০২৫, ১০:৫২ AM

বাংলাদেশের ডিজিটাল অগ্রযাত্রায় যুক্ত হলো নতুন এক মাইলফলক। বিশ্ববিখ্যাত প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠিত স্পেসএক্সের স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা ‘স্টারলিংক’ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে চালু হয়েছে। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাফল্যের সঙ্গে চালু থাকা এই পরিষেবা দেশে ফ্রিল্যান্সিং, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ব্যবসা খাতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে এই প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে ইন্টারনেট সেবার গুণগত মান ও গ্রাহকসেবায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের প্রত্যাশা দেখা দিয়েছে।

আজ মঙ্গলবার (২০ মে) সকালে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বাংলাদেশে স্টারলিংকের ইন্টারনেট পরিষেবা চালুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, "স্টারলিংক অফিসিয়ালি (আনুষ্ঠানিকভাবে) বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করেছে। গতকাল (সোমবার) বিকেলে তারা ফোন কলে আমাকে বিষয়টা জানিয়েছে এবং আজ সকালে তাদের এক্স হ্যান্ডেলে (যোগাযোগমাধ্যম) বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের গ্রাহকরা আজ থেকেই অর্ডার করতে পারবেন। এর মাধ্যমে ৯০ দিনের মধ্যে যাত্রা শুরুতে স্যারের প্রত্যাশাটি বাস্তবায়িত হলো।"

ফয়েজ আহমদ আরও বলেন, খরুচে হলেও এর মাধ্যমে প্রিমিয়াম গ্রাহকদের জন্য উচ্চমান এবং উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা প্রাপ্তির টেকসই বিকল্প তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি যেসব এলাকায় এখনো ফাইবার কিংবা দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা পৌঁছেনি, সেখানে কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ পাবেন, এনজিও ফ্রিল্যান্সার এবং উদ্যোক্তারা বছরব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন উচ্চগতির ইন্টারনেটের নিশ্চয়তা পাবেন বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

৪৭ হাজারে সেটআপ, মিলবে ২ প্যাকেজ

জানা গেছে, স্টারলিংক বাংলাদেশে তাদের আনুষ্ঠানিক সেবা শুরুর পরপরই গ্রাহকদের জন্য দুটি প্যাকেজ চালু করেছে– রেসিডেন্সিয়াল ও রেসিডেন্সিয়াল লাইট। এ দুটির প্রতিটি নির্দিষ্ট প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী গ্রাহকদের জন্য ভিন্ন সুবিধা দিচ্ছে।

স্টারলিংকের সেবার আওতায় বর্তমানে দুটি প্যাকেজ চালু হয়েছে। উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহারে আগ্রহী গৃহস্থালি ও ছোট অফিসের জন্য ‘রেসিডেন্সিয়াল’ প্যাকেজটি নির্ধারণ করা হয়েছে মাসে ৬ হাজার টাকা। আর অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য রয়েছে ‘রেসিডেন্সিয়াল লাইট’ প্যাকেজ, যার মাসিক খরচ ৪২০০ টাকা।

তবে যেকোনো প্যাকেজ গ্রহণের জন্য গ্রাহককে শুরুতে এককালীন ৪৭ হাজার টাকা ব্যয় করে স্টারলিংকের সেটআপ কিট (যন্ত্রপাতি ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম) কিনতে হবে। এতে থাকবে স্যাটেলাইট ডিশ, রাউটার ও পাওয়ার সাপ্লাই ইত্যাদি, যা ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন নিশ্চিত করবে।

এই সেবার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো– এতে কোনো ডেটা সীমা বা গতি সীমা নেই। গ্রাহকরা নিরবচ্ছিন্নভাবে সর্বোচ্চ ৩০০ এমবিপিএস পর্যন্ত গতিতে আনলিমিটেড ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন। এটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এক অনন্য সংযোজন, যেখানে এখনো অনেক এলাকায় ব্রডব্যান্ড বা ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট পৌঁছেনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টারলিংকের এই প্যাকেজগুলো মূলত এমন সব গ্রাহকের জন্য উপযোগী, যারা নিরবচ্ছিন্ন, উচ্চগতির ও নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট চান, বিশেষ করে দূরবর্তী, দুর্গম বা সীমান্তবর্তী অঞ্চলের জন্য এটি হতে পারে যুগান্তকারী একটি সমাধান।

যে প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে এলো স্টারলিংক

বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকায় ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানোর চেষ্টায় রয়েছে। তবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচির আওতায় মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং অপটিক ফাইবারের বিস্তৃতি ঘটলেও দেশের পাহাড়ি, চরাঞ্চল কিংবা সীমান্তবর্তী অনেক অঞ্চলে এখনো মানসম্মত ইন্টারনেট পৌঁছায়নি। এ বাস্তবতায় স্টারলিংকের আগমনকে এক ধরনের গেমচেঞ্জার হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এর চেয়েও বড় কারণ হচ্ছে, গত বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখার ঘটনা।

অভিযোগ রয়েছে, সেসময় দেশজুড়ে চালানো হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পরিকল্পিতভাবে ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউটের ঘটনা সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের যোগসাজশে হয়েছিল। পরে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই ইন্টারনেট পরিষেবা আর যেন কেউ যেন বন্ধ করতে না পারে, সেজন্য স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা চালুর উদ্যোগ নেয়। সে চেষ্টার অংশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরাসরি প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

এর আগে গত ৬ এপ্রিল বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা চালুর জন্য স্টারলিংককে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।

৩ মাসের মধ্যে স্টারলিংক বাণিজ্যিকভাবে চালুর নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা

যেখানে অপটিক ফাইবার বা মোবাইল ব্রডব্যান্ড পৌঁছায় না– সেসব এলাকায় স্টারলিংকের সেবা হতে পারে গেমচেঞ্জার। সেজন্য অতি দ্রুত বাণিজ্যিকভাবে এর কার্যক্রম শুরুর তাগিদ দিয়েছিল সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং জানিয়েছিল, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশে স্টারলিংকের স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা বাণিজ্যিকভাবে চালুর নির্দেশনা দিয়েছেন। বাংলাদেশে স্টারলিংকের আনুষ্ঠানিক যাত্রার মাধ্যমে ৯০ দিনের মধ্যে যাত্রা শুরু করতে প্রধান উপদেষ্টার প্রত্যাশা বাস্তবায়িত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।

বাংলাদেশে বাণিজ্যিক সেবাদানকালে এনজিএসও নীতিমালা মেনে স্টারলিংক স্থানীয় ব্রডব্যান্ড গেটওয়ে বা আইআইজি ব্যবহার করবে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রযুক্তি

বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটর ও অপটিক্যাল ফাইবার ভিত্তিক ইন্টারনেটের আধিপত্য। কিন্তু দেশের একটি বড় অংশ বিশেষ করে হাওর, পাহাড়, চরাঞ্চল এবং সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো এখনো নেটওয়ার্কের বাইরে। স্টারলিংক এখানে পৌঁছে দিতে পারে স্বপ্নের ইন্টারনেট, যা মোবাইল টাওয়ার বা অপটিক ক্যাবলের ওপর নির্ভর করে না। স্রেফ একটি রিসিভার অ্যান্টেনা আর বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেই এ প্রযুক্তি থেকে পাওয়া যাবে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা। গল্পের মতো এই প্রযুক্তির বাস্তবায়ন হয় আকাশে পৃথিবীর কাছাকাছি কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান হাজার হাজার ছোট স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। এগুলোর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে স্টারলিংকের ছোট একটি রিসিভার। এটি এক ধরনের ছোট ছাদে বসানো অ্যান্টেনা, যা ব্যবহারকারীর ঘরে ওয়াইফাই রাউটারের মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করে। ফলে কোনো তারের প্রয়োজন পড়ে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টারলিংক শহর ও গ্রামের মধ্যকার ইন্টারনেট বৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে। দূরবর্তী স্কুলে অনলাইন ক্লাস, টেলিমেডিসিন, স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য হবে। একইসঙ্গে ঘূর্ণিঝড়, বন্যার মতো দুর্যোগে সাধারণ নেটওয়ার্ক নষ্ট হলেও স্টারলিংক টিকতে পারে। তবে প্রযুক্তির এই আশীর্বাদের সুফল পেতে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, প্রণোদনা এবং সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি বলেও মনে করছেন অনেকে।

এশিয়া প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ইনফরমেশন সেন্টারের (এপনিক) এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল সদস্য, ইন্টারনেট এবং নেটওয়ার্ক প্রকৌশলী সুমন আহমেদ সাবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি বাংলাদেশের জন্য খুব ভালো একটি সংযোজন। কেননা এমন টেকনোলজি আমাদের দেশে নেই। এর এমন কিছু ব্যবহার আছে, যা অন্য কোনো প্রযুক্তি দিয়ে কার্যকর করা সম্ভব নয়। সেদিক থেকে এটি বাংলাদেশের ইন্টারনেটের জন্য খুব ভালো একটি সংযোজন। এর মাধ্যমে অনেক ধরনের পরিষেবা পাওয়া যাবে। তবে সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, এর মাধ্যমে দুর্গম এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেই ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া যাবে। এতে করে ভালো ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার জন্য একটি ভালো প্রতিযোগিতাও গড়ে উঠবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, স্টারলিংকের চালু দেশকে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। সঠিক পরিকল্পনা, নীতি ও প্রণোদনা থাকলে এই প্রযুক্তি বাংলাদেশের ডিজিটাল কাঠামোতে এক নতুন বিপ্লব ঘটাতে পারে। সরকার, নীতিনির্ধারক, প্রযুক্তিবিদ এবং অপারেটরদের যৌথ প্রচেষ্টায় স্টারলিংক হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের ডিজিটাল কানেক্টিভিটির অন্যতম স্তম্ভ। আর এই পথচলা যদি সফল হয়, তবে ‘সবার জন্য ইন্টারনেট’ লক্ষ্য অর্জন আর খুব দূরে থাকবে না।

তবে এই প্রযুক্তি চালুর ফলে চাপ তৈরি না হলেও কিছু দেশীয় ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি ইমদাদুল হক। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্টারলিংক চালু হওয়ায় দেশীয় আইএসপিগুলো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে আমাদের প্রতিযোগিতা বাড়বে। তবে শহরগুলোতে স্টারলিংকের সেবা দেওয়ার অনুমোদনের দরকার ছিল না। দেশের পাহাড়ি ও প্রত্যন্ত যেসব অঞ্চলে ব্রডব্যান্ড পৌঁছানো সম্ভব নয় সেসব এলাকায় স্টারলিংককে অনুমোদন দিলে ভালো হতো। এখন সরকার যেহেতু নতুন প্রযুক্তি দিতে চাইছে আমরাও সেটিকে প্রতিযোগিতা হিসেবেই নেব। সবমিলিয়ে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন সম্ভাবনা রয়েছে।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী ধরনের উদ্যোগ আইএসপিরা নেবে– জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেবার মান আরও বাড়াতে হবে। আমরা খুব স্বল্প খরচে ব্রডব্যান্ড সেবা দিচ্ছি। যা স্যাটেলাইট ইন্টারনেট দিতে পারবে না। তবে এ কথা সত্য যে, কর্পোরেট বিভিন্ন জায়গায় আমরা বর্তমান অনেক গ্রাহক হারাব। সরকারের উচিত হবে আমাদের রক্ষার জন্য বিকল্প আরও ব্যবস্থা রাখা। দেশীয় কোম্পানিগুলো যেন হারিয়ে না যায় সেদিকে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। একইসঙ্গে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন গ্রাম-অঞ্চলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবার মান বাড়াতে প্রতিবন্ধকতা দূর করতেও সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।