পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনা পলিথিন বন্ধ হোক
আমরা বাজারে গেলে প্রতিটি পণ্যের সাথে দেওয়া হয় আলাদা পলিথিন । মাছের জন্যও আলাদা ব্যাগ। পেয়াজ-রসুনের জন্যও তেমন। প্রতিদিন একজন ক্রেতা বাজার থেকে ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের জন্য ৫/৬টি পলিথিন ব্যাগে করে বাজার নিয়ে ফেরেন ঘরে। বাজার রেখে সেগুলোর ঠিকানা হয় ময়লার ঝুড়ি। সেখান থেকে এই পলিথিনের সিংহভাগই ফেলা হয় এখানে সেখানে। যা আমাদের পরিবেশকে ধ্বংস করছে প্রতিনিয়ত।
এভাবে প্রতিদিন লাখ লাখ নগরবাসীর হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনা পলিথিন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পলিথিনের আগ্রাসন এক বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ২০০২ সালে শর্ত সাপেক্ষে সব রকমের পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, মজুত ও বিতরণ নিষিদ্ধ করলেও এতো বছরে সেটি দেখা গেছে শুধু কাগজে কলমে। অবাধে হয়েছে উৎপাদন, যত্রতত্র হয়েছে ব্যবহার। এই সময়ের মধ্যে পলিথিন যেমন হয়ে উঠেছে প্রত্যাহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তেমনি এই পলিথিন যে নিষিদ্ধ তা একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলেন মানুষ। তবে সম্প্রতি অন্তবর্তীকালীন সরকার এতে নজর দিয়েছে।
এই বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো ধরনের পলিথিন বা পলি ব্যাগ রাখা যাবে না এবং ক্রেতাদের দেওয়া যাবে না। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের জন্য রাখা হবে।
পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এক সপ্তাহের মধ্যে সব সুপারশপের সঙ্গে সভা করে পাটের শপিং ব্যাগের সরবরাহ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
তিনি জানান, পরিবেশ অধিদপ্তর ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইএসডিওর সঙ্গে বিকল্প পরিবেশবান্ধব উপাদানে তৈরি, পাট বা কাপড়ের ব্যাগের উৎপাদনকারীদের নিয়ে একটি মেলার আয়োজন করবে। মেলায় সুপার শপের কর্তৃপক্ষ ও উৎপাদনকারীরা নিজেদের চাহিদা এবং সরবরাহর বিষয়ে আলোচনা করতে পারবে।
সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে পরিবেশবিদ সকলে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে ভালো বিকল্প রাখতে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। জানতে চাইলে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোললেন (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, সরকারের এই পদক্ষেপে সকলকে সহযোগিতা ও সাধুবাদ জানানা উচিত। তবে ভালো বিকল্প যদি না থাকে, তাহলে এই পলিথিন বন্ধ করা কিন্তু কঠিন। ভালো বিকল্পের সঙ্গে খুব স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) ওয়েতে করতে হবে। তাহলে এই পদক্ষেপ ফলপ্রসু হতে হবে।
অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, লন্ডনে একসময় ফ্রিতে পলিথিন দিতো। কিন্তু একটা সময় তারা এগুলো বন্ধ করে দিলো। বলা হলো স্থানীয় মুদ্রার ৫ টাকা দিয়ে পলিথিন কিনতে হবে। এতে ৯০ ভাগ পলিথিন ব্যবহার কমে যায়। এটা ওখানে কাজ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে যে এভাবে কাজ করবে কি না, সেটা সময় বলবে। তবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত যদি নেওয়া যায়, তাহলে শতভাগ না হলেও কাছাকাছি জায়গায় যাওয়া যাবে।
জনগণ পলিথিন বর্জনের এই আন্দোলনে অংশ নিতে চায় জানিয়ে এই পরিবেশবিদ বলেন, এজন্য বিকল্প প্রস্তুত রাখতে হবে। যেমন ধরুন কিছু কিছু জায়গায় পলিথিন লাগবে। ফ্রিজে আপনি মাছ, মাংস রাখবেন, সেখানে পলিথিনের দরকার পড়বে। পাউরুটিতে পলিথিন লাগবে। এজন্য পুনঃব্যবহার করা যায় এবং ফ্রড গ্রেডের পলিথিনগুলো রাখতে হবে এসব বিশেষ কাজের জন্য। নরমাল পলিথিন বন্ধ করতে হবে। নরমাল পলিথিন এবং এসব পলিথিনের মধ্যে পার্থক্য কি হবে, সেটা ঠিক করতে হবে। ওয়ান টাইম পলিথিন কিন্তু পূনঃব্যবহার বা রিসাইকেল হবে না। সুতরাং পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।
পলিথিন-প্লাস্টিক দূষণ রোধে জাতীয় মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত থাকলেও ২০২০ সালে প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ টনের মতো, যা মোট ব্যবহারের প্রায় ২০ ভাগ।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, এ সময়ে উৎপাদিত ১৪ লাখ ৯ হাজার টন প্লাস্টিক পণ্যের অর্ধেকের বেশি ব্যবহৃত হয়েছিল পণ্যের মোড়ক ও প্যাকেজিং খাতে। বিশেষত পলিথিনের ভয়ংকর আগ্রাসন আমাদের সামগ্রিক পরিবেশ ও বাস্তু ব্যবস্থাপনাকে চরম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ঢাকা শহর ইতোমধ্যে বিশ্বের অন্যতম বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যের অপরিমিত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এর জন্য অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের প্রতিটি অলিগলি, ড্রেন, নালা, খাল ও জলাশয় প্লাস্টিক বোতল ও পলিথিনে আবদ্ধ হয়ে আছে। আর সেখানে পানিসহ সবকিছুই দূষিত হচ্ছে। আর সেই বদ্ধ জলাশয়ের দূষিত পানিতে জন্ম নিচ্ছে ডেঙ্গু রোগবাহিত এডিস মশাসহ ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, কলেরা, টাইফয়েডের মতো নানা ধরনের রোগবালাই। শারীরিক ও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে এই পলিথিন। ম্যানহোল, নালা, খাল, নদীতে পড়ে থাকা ব্যাগগুলো বৃষ্টি হলে বিপত্তি ঘটায়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকায়ই প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হয়। পলিথিন ছাড়া অন্য প্লাস্টিক বর্জ্যও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। পলিথিন মাটিতে মিশে যেতে সময় লাগে ২’শ থেকে ৪’শ বছর। পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যের ভয়াবহ দূষণের শিকার হয়ে ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে পরিবেশ, প্রাণ-প্রকৃতি ও জনস্বাস্থ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশের নাম উঠে আসছে। পলিথিন বর্জ্যের ক্ষতিকর দিকগুলো আলোচিত হচ্ছে নানাভাবে।
রাজধানীর মেরাদিয়ার কাঁচাবাজারে সবজির ব্যবসা করেন গোলজার মোল্লা। প্রতিদিন তার প্রায় ২ থেকে ৩ কেজি পলিথিনের প্রয়োজন হয়। তিনি বলেন, বাজার করতে আসলে কেউ ব্যাগ নিয়ে আসে না। সবাই বলে পলিথিনে দেন। এখন পলিথিন না রাখলে তো আমার ব্যবসা হবে না। জিনিস দিবো কিসে?
গোলজার মোল্লার মতো এভাবে পুরো রাজধানী জুড়ে হাজার হাজার দোকান থেকে কোটি কোটি পলিথিন ছড়িয়ে পড়ছে নগরে। আর এই সুযোগে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে পলিথিন উৎপাদনের এসব কারখানা। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিভিন্ন পলিথিন ও প্লাস্টিক কারখানা ভাবনাহীনভাবে উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। নেই কোনো আইনের প্রয়োগ।
রামপুরা কাঁচাবাজারে বাজার করতে আসা শামীম শফিক জানান, আমরাও চাই বাজার থেকে পলিথিন উঠে যাক। যেসব দেশে পলিথিন নেই সেসব দেশ চলছে না? তবে বাজার থেকে পলিথিন নির্ভরতা কমাতে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে বিদেশে যেভাবে পুনঃব্যবহারযোগ্য পলিথিন টাকার বিনিময়ে কিনতে হয়, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। আর পলিথিন উৎপাদনের কারখানাগুলো বন্ধ করতে হবে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশম স্থানে উঠেছে। ২০০৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এর ব্যবহার তিনগুণের বেশি বেড়েছে। ঢাকায় একবার ব্যবহারের পর এগুলোর ৮০ শতাংশ মাটিতে ফেলা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকাতেই মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২২.২৫ কেজি এবং ঢাকায় প্রতিদিনের প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ ৬৪৬ টন, যা সমগ্র বাংলাদেশের বর্জ্যের ১০ শতাংশ। রাজধানীর চারপাশের চারটি (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা) নদীতে প্রায় ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া যাচ্ছে, যার অর্ধেকই পাওয়া গেছে বুড়িগঙ্গায়। কক্সবাজারে পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন ১৩০ টন আর্বজনা হয়। এর বেশিরভাগই পলিথিন।
পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ২০১৫ সালে পাটের পলিথিন ব্যাগ উদ্ভাবনের কথা জানিয়ে আলোড়ন তোলেন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা মোবারক আহমেদ। পাট থেকে সেলুলোজ সংগ্রহ করে তা দিয়ে এ ব্যাগ তৈরি করা হয়। এটি দেখতে সাধারণ পলিথিনের মতই, তবে তা পচনশীল। ব্যাগটি বাজারজাত করতে ২০১৮ সালে একটি পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে সেই ব্যাগ এখনো বাজারে আনা যায়নি।
২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় এই ব্যাগ উৎপাদনের জন্য। ওই টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক দ্রব্য কেনা হয়। সেই ব্যাগ শুধু মতিঝিলে বিজেএমসির কার্যালয় থেকে কেনা যায়। পাট থেকে উৎপন্ন এই ব্যাগকে পলিথিনের বিকল্প বলা হচ্ছে গত প্রায় ৯ বছর ধরে। কিন্তু বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারছে না সরকার।