প্রবাসীর অ্যাপেও দুর্নীতি; দুদকের জালে বিএমইটির সাবেক ডিজি

নিজস্ব প্রতিবেদক
জার্নাল ডেস্ক জার্নাল ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৪৭ PM

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) প্রবাসীদের নাম নিবন্ধন এবং স্মার্ট কার্ড ও প্রশিক্ষণ সনদ সরবরাহের কাজে একটি দুর্বল অ্যাপ ব্যবহার করছে। প্রায় ৪০ লাখ প্রবাসীর নিবন্ধন ও স্মার্ট কার্ড দেওয়া এই অ্যাপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রেও বিধিবিধান মানা হয়নি। এসব অনিয়মের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সম্প্রতি তদন্ত শুরু করেছে। 

এ বিষয়ে দুদকের পক্ষ থেকে ‘আমি প্রবাসী’ নামের অ্যাপ-সংশ্লিষ্ট সব ধরনের তথ্য চেয়ে ৯ নভেম্বর বিএমইটির মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আজকের পত্রিকার এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

সরকারের বিভিন্ন সেবার ফিসহ সব ধরনের রাজস্ব সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারি সিঙ্গেল অ্যাকাউন্ট (টিএসএ) বা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের একক হিসাবে জমা রাখতে হয়। এই রাজস্ব ভাগাভাগির আইনগত কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বিএমইটি ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে বছরের পর বছর চালিয়ে যাচ্ছে রাজস্ব ভাগাভাগির মতো কাজ। প্রবাসীদের জন্য তৈরি করা অ্যাপ ব্যবহার করেই চলছে এই বাণিজ্য।

বিএমইটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিএমইটি ২০২১ সালে প্রথম ‘থ্যান সিস্টেম’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রবাসীদের নাম নিবন্ধনের জন্য চুক্তি করে। এখানে নাম নিবন্ধন করতে যে টাকা একজন প্রবাসী পরিশোধ করেন, তার একটি অংশ থ্যান সিস্টেম নিজের হাতে রেখে দেয়। এরপর গত জুলাই থেকে নতুন করে স্মার্ট কার্ড ও প্রশিক্ষণ সনদের কাজটিও দেওয়া হয়েছে একটি ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠানকে। স্মার্ট কার্ড বা প্রশিক্ষণ সনদ পেতে ‘আমি প্রবাসী লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে প্রত্যেক প্রবাসীর ৭৫০ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। যাচাই করে দেখা যায়, ‘আমি প্রবাসী ডটকম’ ওয়েবসাইটটি একটি মার্কিন কোম্পানির নামে নিবন্ধিত। এতে সংশ্লিষ্ট প্রবাসী কর্মীদের সব ধরনের তথ্য অন্যদের হাতে চলে যাচ্ছে।

ওই কর্মকর্তারা জানান, আমি প্রবাসী লিমিটেড ও থ্যান সিস্টেমের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে শুরুতেই বিতর্কের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে ৯ নভেম্বর বিএমইটির সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলমের কর্মকালীন বেশ কিছু কাজের বিস্তারিত তথ্য চেয়ে দুদক চিঠি দেয়। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদের সই করা ওই চিঠিতে ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপের ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রে ডিপিপি, অনুমোদিত প্রাক্কলন, অর্থ বরাদ্দ, পত্রিকায় প্রকাশিত দরপত্র বিজ্ঞপ্তি, বাজারদর যাচাইকারী কমিটির প্রতিবেদন, দরপত্র খোলার কমিটির তালিকা, দরপত্র বাছাই কমিটির তালিকা, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন, নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড, কার্যাদেশ এবং অ্যাপের সম্ভাব্যতা যাচাই ও চুক্তিসহ যাবতীয় নথি চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ওই অ্যাপের মাধ্যমে এ পর্যন্ত কতজন বিদেশগামী কর্মীকে অনলাইন বা ম্যানুয়াল সনদ দেওয়া হয়েছে; তা কোন প্রক্রিয়ায় দেওয়া হয়েছে, সেসব বিধিবিধান ব্যাখ্যাসহ চাওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সাবেক মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম দায়িত্ব পালনকালে ৪০টি টিটিসি প্রকল্পের অনুকূলে উন্নয়ন, সংস্কারসহ যেসব বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা-ও ছক আকারে জমা দিতে বলেছে দুদক। ওই কর্মকর্তা দায়িত্বকালে যেসব রিক্রুট এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে কর্মী পাঠিয়েছেন, সেগুলোর বিষয়েও বিস্তারিত তথ্য পাঠাতে বলা হয়েছে চিঠিতে।

দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বিএমইটির সাবেক মহাপরিচালকের বিষয়ে চিঠি দিয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছিল। আমরা তথ্য পেয়েছি। পরবর্তী কার্যক্রমের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’

এসব বিষয়ে কথা বলতে বিএমইটির সাবেক মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলমের ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। পরে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিষয় জানিয়ে এসএমএস পাঠানো হয়। এরপরও তিনি জবাব দেননি এবং ফোনও ধরেননি।

বিএমইটির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারের রাজস্ব এভাবে ভাগাভাগি করার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া রাজস্বের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের সংযুক্ত হিসাবের পরিবর্তে একটি বেসরকারি ব্যাংকে জমা করা হচ্ছে। এ কাজ সরকারি ক্রয় বিধিমালা (পিপিআর), সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইনের ধারা ৭ এবং ট্রেজারি রুলসের ৩ ও ৭(১) বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সরকারের সব ধরনের রাজস্ব ও বিভিন্ন সেবা ফি সরাসরি সরকারের সংযুক্ত তহবিলে জমা করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত টিএসএতে জমা রাখার বিধান আছে। অর্থ বিভাগের সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনো বিভাগ, মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর বা পরিদপ্তর কোনো বেসরকারি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে রাজস্ব সেবা ফি বাবদ প্রাপ্ত অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক বা এর এজেন্ট সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ছাড়া অন্য কোনো ব্যাংকে জমা রাখলে সেটি হবে আইন ও বিধি পরিপন্থী। কিন্তু বিএমইটি দুটি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে জমা করছে। আবার সেই টাকা নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাগাভাগি করে নিচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমইটির মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।