কেমন হবে এবারের শীতকাল- যা জানাল আবহাওয়াবিদরা
ঘূর্ণিঝড় ‘মিগজাউম’ এর প্রভাবে গত বুধবার (৬ ডিসেম্বর) থেকে ঢাকাসহ দেশজুড়ে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে আজ শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে এবং একই সাথে রাতের তাপমাত্রা এক থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস কমতে পারে।
এর সাথে সাথে শীত শুরু হওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। ঠিক কবে থেকে শীতকাল শুরু হতে পারে আর এবারের শীত কতটা তীব্র হবে?
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মূলত শীতকাল হলেও সাধারণত দেশের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষত উত্তরাঞ্চলে তাপমাত্রা কমতে শুরু করে নভেম্বর মাসের শেষদিক থেকেই যেটার খুব একটা তারতম্য হয়নি এবারও।
তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি কিছুটা পাল্টে গেছে যার কারণে শীতকালের সময় এবং ধরণ ঠিক আগের মতো হচ্ছে না।
শীতের শুরু কবে?
আবহাওয়াবিদরা বলেন, সাধারণত স্বস্তিদায়ক তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে বোঝানো হয়। আর ডিসেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের সময়কালকে শীতকাল হিসেবে ধরে থাকেন।
মিগজাউমের প্রভাবে এই বৃষ্টিপাতের পর এই মাসের ১০ তারিখের পর থেকে তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের একজন আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক। তিনি বলেন, উত্তরাঞ্চলে কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে আসতে পারে।
এটিকে শৈত্যপ্রবাহ হিসেবেও দেখা যায়, কারণ শীতকালে ২.৬ থেকে শুরু করে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমে গেলে সেটা শৈত্যপ্রবাহের পর্যায়ে পড়ে।
গত ৩০ বছরের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছেন, ডিসেম্বর মাসে সাধারণত একটি থেকে দুটি মৃদু শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনা থাকে।
অবশ্য আরেক জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. আবদুল মান্নান মনে করছেন শীতকালের শুরুটা মূলত ডিসেম্বর মাসের শেষার্ধের দিকে অর্থাৎ ১৬ তারিখের পর কোনো একটা সময় থেকে হবে।
তার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বৃষ্টিপাতের পরপর তাপমাত্রা হঠাৎ করে নেমে গেলে শীত অনুভূত হবে ‘তবে প্রকৃত অর্থে এটি শীতকাল নয়’।
সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কমার পাশাপাশি যখন আকাশ মেঘমুক্ত হয়ে বায়ুমণ্ডল পুরোপুরি শুষ্ক হয়ে যাবে তখন শৈত্যপ্রবাহের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যেটা হতে কিছুটা সময় লাগবে বলে মনে করছেন আবদুল মান্নান।
তিনি বলছিলেন, এ মাসের শেষ সপ্তাহের দিকে একটা মৃদু শৈত্যপ্রবাহ আসার সম্ভাবনা রয়েছে, তবে সেটি পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ মাসের দ্বিতীয়ার্ধ, অর্থাৎ ১৬ তারিখের পর থেকে মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যে প্রকৃত অর্থে শীতকাল শুরুর সম্ভাবনা দেখছেন তিনি যখন রাতের তাপমাত্রা ১২ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামবে।
কেমন হবে শীতকাল?
বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার রেকর্ড রাখা শুরু হবার পর থেকে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি গরম পড়েছিল এ বছরেরই জুন মাসে।
আমেরিকা ও ইউরোপের মতো শীতপ্রধান জায়গায় তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করেছে মানুষ। বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা উচ্চতম রেকর্ড ছুঁয়েছে যার একটা প্রধান কারণ ছিল ‘এল নিনো’ নামে প্রাকৃতিক আবহাওয়া চক্র।
এই ‘এল নিনো’ ও একই সাথে বিশ্বের বাড়তে থাকা তাপমাত্রার প্রভাবে এবারের শীতকালটা আগের তুলনায় কিছুটা উষ্ণ হওয়ার কথা জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
এল নিনো সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে যে অবস্থাটা মে মাস পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হতে পারে এবং এল নিনো সক্রিয় থাকা অবস্থায় স্বাভাবিকের চেয়ে সাধারণত বেশি তাপমাত্রা দেখা যায় বলে জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবুল কালাম মল্লিক।
প্রতি তিন থেকে সাত বছরের মধ্যে একবার এই এল নিনো দেখা দেয়- যখন তাপমাত্রা উর্ধমুখী হয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ৩০ বছরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার গড় হিসেবে স্বাভাবিকভাবে ডিসেম্বর মাসে সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ১৪.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। এ বছর ডিসেম্বর মাসে সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ১৪.৫ ডিগ্রি থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করতে পারে বলে ধারণা দেন আবুল কালাম মল্লিক। পাঁচ বছরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার গড় চিত্রের দিকে তাকালে তাপমাত্রা বাড়তে থাকার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
ডিসেম্বর মাস
২০১৮ – ১৩.৯২
২০১৯ – ১৪.২১৪
২০২০ – ১৪.২৫
২০২১ – ১৫.৪৫
২০২২ – ১৫.১৯৪
জানুয়ারি মাস
২০১৮ – ১১.৩৩
২০১৯ – ১২.৩৭
২০২০ – ১৩.০৯
২০২১ – ১৩.৩২
২০২২ – ১৩.৬৯
৩০ বছরের তথ্য অনুযায়ী জানুয়ারি মাসের গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে যেটাও এবার সামান্য বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ তথ্য অবশ্য পুরো দেশজুড়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা যা রেকর্ড করা হয় তার গড় হিসাব। অঞ্চলভেদে তাপমাত্রার তারতম্য হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে এবার তেমন শীত পড়বে না সেটা ভাবলেও ভুল হবে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে আবহাওয়ার ব্যাপারে কোনো কিছুই নিশ্চিত করে বলা যায় না উল্লেখ করে আবদুল মান্নান বলছেন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর এই সময়ে যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতি ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে।
গত তিন মাসে পরপর কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, আবহাওয়া বিরূপ আচরণ করলে শর্ট পিরিয়ডে তীব্র শৈত্য প্রবাহ আসার সম্ভাবনাকেও কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে, এটুকু বলা যায় যে সামগ্রিকভাবে এবার শীতের সময় কিছুটা ওয়ার্ম থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
শীতের পরিবর্তন
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে শীতের সময়কালেরও কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ডিসেম্বর মাসকে শীত শুরু হওয়ার স্বাভাবিক সময় হিসেবে ধরা হলেও আগের তুলনায় শুরুর সময়টা পেছানোর প্রবণতা দেখছেন আবুল কালাম মল্লিক।
ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে শীতের প্রবণতা কম হচ্ছে আবার অন্যদিকে শেষটা ফেব্রুয়ারি মাস ধরা হতো যেটা এখন মার্চের প্রথম সপ্তাহ নাগাদে গিয়ে ঠেকছে বলে জানান তিনি।
শীতের সময়কাল কম লক্ষ্য করছেন আবদুল মান্নানও। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে গত কয়েক বছর ধরে ‘ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের পর শীত অনুভব হয় না তেমন। এমনকি, গত কয়েক বছরে জানুয়ারি মাসেও আমাদের এক্সপেক্টশন অনুযায়ী শীতের অনুভূতি আসে নাই’ বলছিলেন তিনি।
এ ছাড়া শৈত্যপ্রবাহের ব্যাপ্তিকালেও পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন আবহাওয়াবিদরা। শীতল রাত কত সময় ধরে চলবে সেদিকে ২০১৫ সালের পর থেকে পরিবর্তন হয়েছে বলে জানান আবুল কালাম মল্লিক।
তিনি বলছিলেন কত সময় ধরে শৈত্যপ্রবাহ চলবে সেই হিসেবে ‘তীব্র ও মাঝারি ধরণের শৈত্যপ্রবাহ কমে গেছে’ বলছিলেন তিনি। সে তুলনায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহের সময়কালটা বেড়েছে জানাচ্ছিলেন তিনি।
সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ভিত্তিতে অন্তত তিন দিন স্থায়িত্বকাল অনুযায়ী শৈত্যপ্রবাহকে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়।
মৃদু –> ৮ - ১০ ডিগ্রি
মাঝারি –> ৬-৮ ডিগ্রি
তীব্র –> ৪-৬ ডিগ্রি
অতি তীব্র –> ৪ ডিগ্রির নিচে
মৃদু শৈত্যপ্রবাহ এখন আগের তুলনায় বেশি সময় ধরে থাকছে এবং মাঝারি থেকে অতি তীব্র ধরণের তাপমাত্রার দিনসংখ্যা কমে আসছে বলে জানান আবুল কালাম মল্লিক।
জানুয়ারি মাস নাগাদ সাধারণত একটি থেকে দুটি মাঝারি থেকে তীব্র ধরণের শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনা থাকে যেটা এবারও থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে আবহাওয়ার ক্ষেত্রে পূর্বাভাস দেয়ার সমস্যার দিকও রয়েছে। যেমন মিঃ মল্লিক বলছিলেন ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পর্যন্ত মোটামুটি সঠিক হিসেব পাওয়া যায়। এরপর যত বেশি সময়ের হিসেব করা হয় তত সেটা পুরোপুরি সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কমতে থাকে।
পাঁচ দিনের হিসেব করলে সেটা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশে নেমে আসে আর সাত দিন পর্যন্ত গেলে সেটা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশে নেমে আসে বলছিলেন আবুল কালাম মল্লিক।