জানাশোনা হোক : সোশ্যাল মিডিয়া সর্ম্পকে
আসুন জানি সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত...
প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে সোশ্যাল মিডিয়া কী? একটি ইংরেজি শব্দ, যার অর্থ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বইয়ের ভাষায়—যেসব ওয়েবসাইট ও অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে ও ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট শেয়ার করে, তাকে সোশ্যাল মিডিয়া বলা হয়। বর্তমান সময়ে মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া সাইট।
সোশ্যাল মিডিয়ার যেভাবে এলো:
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্মের গল্প যদি খোঁজা হয়, তাহলে ফিরে যেতে হবে ১৮৪৪ সালের মে মাসের ২৪ তারিখে, যেদিন স্যামুয়েল মোর্স বাল্টিমোর থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে তাঁর প্রথম টেলিগ্রামটি পাঠিয়েছিলেন। কিছু ডট ও ড্যাশের মাধ্যমে তিনি সেদিন লিখেছেন ‘ঈশ্বর কী করেছেন’। সেই প্রথম টেলিগ্রামের পরের প্রায় ১৮০ বছর যোগাযোগমাধ্যমে এক বিপ্লব ঘটে গেছে। সারা দুনিয়াকে মানুষ নিয়ে এসেছে মাত্র সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি পর্দার মাঝে।
প্রথম সোশ্যাল মিডিয়া কোনটি?
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে দুটি সাইটের নাম আসে; প্রথমটি জিওসিটি ও অন্যটি সিক্সডিগ্রি। তবে ১৯৯৭ সালে তৈরি করা সিক্সডিগ্রিস ডটকম-কেই অধিকাংশ মানুষ প্রথম সোশ্যাল মিডিয়া হিসেবে বিবেচনা করে। সিক্সডিগ্রিস ব্যবহারকারীরা তাঁদের কাছের লোকেদের সাইটে নিবন্ধিত করতে পারত এবং তাদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ডিগ্রি—এভাবে বিভাজন করতে পারত।
প্রথম দিকের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে সিক্সডিগ্রি, ফ্রেন্ডস্টার, লিংকডিন ইত্যাদি।
পরে ২০০১ সালে ফ্রেন্ডস্টার আসে, যার সঙ্গে খুব অল্প দিনের মধ্যেই কয়েক মিলিয়ন ব্যবহারকারী যুক্ত হয়। ২০০২ সালে লিংকডিন প্রতিষ্ঠা হয় ক্যারিয়ারের প্রতি মনোযোগী পেশাদারদের এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য নিয়ে। বর্তমানে এই লিংকডিনে প্রায় ৭৪০ মিলিয়ন লোক প্রতিনিয়ত চাকরি খুঁজছে, চাকরি দিচ্ছে কিংবা নিজের দক্ষতা বৃদ্ধিতে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। ২০০৩ সালে মাইস্পেস আসার পর ২০০৬ সালে এটি হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভিজিট করা সাইট। কিন্তু ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ফেসবুক সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়াকে ছাড়িয়ে গিয়ে নিজের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নেয়।
সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন ধরন
সোশ্যাল মিডিয়া বর্তমানে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। কনটেন্ট ও যোগাযোগের ধরনের ওপর ভিত্তি করে সোশ্যাল মিডিয়াকে বেশ কিছু ভাগে ভাগ করা যায়—
কনটেন্ট ও যোগাযোগের ধরনের ওপর ভিত্তি করে সোশ্যাল মিডিয়াকে বেশ কিছু ভাগে ভাগ করা যায়।
১. সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইট: সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর মধ্যে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়। এই ধরনের সাইটগুলো মানুষের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ করিয়ে দেয়। আপনি চাইলেই আপনার নিজস্ব গ্রুপ ও কমিউনিটি তৈরি করে নিতে পারবেন; আপনার আইডিয়া ও তথ্য শেয়ার করতে পারবেন। মানুষ নতুন বন্ধু তৈরি করতে, নতুন তথ্য জানতে, নিজের মেধার সম্পর্কে সবাইকে জানাতে এই ধরনের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে থাকে। ফেসবুক, টুইটার ও লিংকডিন এই ধরনের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট।
২. বার্তা আদান-প্রদানভিত্তিক: আমরা আমাদের বন্ধুর সঙ্গে ইনবক্সে শেয়ার করি। এ ক্ষেত্রে আমরা ব্যবহার করি হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, উইচ্যাট, ভাইভার, টেলিগ্রাম। এই ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া আমরা সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করি। এমন অ্যাপের মাধ্যমে আমরা গ্রুপ তৈরি করা, ফাইল আদান-প্রদানসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতে পারি।
৩. ছবি ও ভিডিও শেয়ারের সাইট: কনটেন্টের ধরনের ওপরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নির্ধারিত হতে পারে। ইনস্টাগ্রাম, ইমগুর, ইউটিউব ও ভিমিও—এই সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলো গড়ে উঠেছে ভিডিও ও ছবি শেয়ারের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। ইউটিউব বর্তমানে জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারের প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। আর ইনস্টাগ্রাম হয়ে উঠেছে ছবি শেয়ারের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। তবে বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে স্ন্যাপচ্যাট ও টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্ম। এই ধরনের প্ল্যাটফর্মগুলো অগমেন্টেড রিয়্যালিটি, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি, গানের অংশ বা ফিল্টার ব্যবহার করে ছবি শেয়ার ও ভিডিও তৈরিতে নিয়ে এসেছে ভিন্নতা।
৪. আলোচনাভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম: এসব প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, প্রশ্ন ও উত্তর ইত্যাদি নানা ধরনের কনটেন্ট শেয়ার করা হয়। কোরা, রেডিট মূলত এই ধরনের প্ল্যাটফর্ম। যেমন কোরাতে আপনি একটি প্রশ্ন করতে পারেন। সেই প্রশ্নটি হতে পারে শিক্ষা, ব্যবসা, অর্থনীতি কিংবা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়ে। এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর আবার যে কেউ দিতে পারবে। এভাবেই কোরাতে বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে একটি কমিউনিটি। রেডিটে একটি টপিকের ওপর আলোচনা এবং এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে একটি কমিউনিটি।
সোশ্যাল মিডিয়া হতে আয়ের উপায়
সোশ্যাল মিডিয়াগুলো যে বর্তমানে শুধুমাত্র যোগাযোগেরই মাধ্যম, তা কিন্তু নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলো হয়ে উঠতে পারে অর্থ আয়ের অন্যতম উৎস। সোশ্যাল মিডিয়া হতে যেভাবে আপনি আয় করতে পারেন তা হলো—
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলো হয়ে উঠতে পারে অর্থ আয়ের অন্যতম উৎস।
১. কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার:
বিভিন্ন ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে যারা কনটেন্ট তৈরি করছে, তাদের সেই কনটেন্ট শেয়ারের জন্য অর্থ প্রদান করে সংশ্লিষ্ট প্ল্যাটফর্ম। আপনি কনটেন্ট ক্রিয়েটর হলে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে মনিটাইজেশন বা তাদের নিজস্ব পার্টনারশিপ প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত হতে আবেদন করতে পারেন। নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করতে পারলে আপনিও আপনার কনটেন্টের বিনিময়ে আয় করতে পারবেন। আপনার কনটেন্টগুলো যদি একটি নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক হয়, কিংবা আপনার একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি বা বয়স বা পেশার একটি ফ্যানবেজ থাকে, তাহলে বিভিন্ন ব্র্যান্ড আপনার শরণাপন্ন হবে, যারা ওই নির্দিষ্ট বয়স, শ্রেণি বা পেশার মানুষের কাছে পৌঁছাতে চায়। তাদের সেই পণ্য বা সেবা টাকার বিনিময়ে আপনার পেজ বা চ্যানেলে প্রচারের মাধ্যমে আপনিও চাইলে ভালো আয় করতে পারেন।
২. ব্যবসা স্থাপনের মাধ্যমে:
আপনি বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিক্রির মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে আয় করতে পারেন। ধরুন, আপনার বাড়ি রাজশাহী। রাজশাহী থেকে আপনি খেজুরের গুড় এনে ঢাকায় বিক্রি করতে চান। এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেজ খুলে আপনি চাইলে নিজের পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। ফেসবুকে এখন অনেকেই নিজের ব্যবসার প্রচার চালাচ্ছেন। আবার অনেকে ব্যবসাটাই দাঁড় করিয়েছেন ফেসবুক পেজকে ভিত্তি করে। এখন আপনি সহজেই একটি ফেসবুক পেজ খুলে সেই পেজে যথাযথ প্রমোশোনের মাধ্যমে নিজের পণ্য বিক্রি করতে পারেন। বর্তমান সময়ে এফ-কমার্স বা ফেসবুক-কমার্স আয়ের খুব জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
৩. সোশ্যাল মিডিয়া সংক্রান্ত-সেবা প্রদান:
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবসাকে বড় করার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে। আপনি সহজেই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আপনার পণ্য কাঙ্ক্ষিত গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে পারবেন। তাই বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বর্তমানে ডিজিটাল মার্কেটিং এক্সপার্ট, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার বা সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এক্সপার্ট নিয়োগ করছে। আপনি নিজেও সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট, অ্যাড মার্কেটিং শেখার মাধ্যমে এই সেবা প্রদানে দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন, যা আয়ের পথ খুলে দেবে। সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট এবং সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এই সময়ে বেশ ভালো একটি পেশায় পরিণত হয়েছে। বাজারে এর চাহিদাও ক্রমশ বাড়ছে।
সোশ্যাল মিডিয়া বর্তমানে মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে অধিকাংশ মানুষের দিন শুরু হয় সোশ্যাল মিডিয়াতে ঢুঁ মারার মাধ্যমে। আর দিন শেষে সোশ্যাল মিডিয়াতে স্ক্রল করাটা তো রীতিমতো অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের আদতে সামাজিক করে তুলছে, নাকি আমরা দিন দিন হয়ে উঠছি আরও অসামাজিক, তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে।