বিশাল জনশক্তি প্রয়োজন সৌদির; পিছিয়ে পড়তে পারেন বাংলাদেশিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক
জার্নাল ডেস্ক জার্নাল ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৯ জুলাই ২০২৫, ১০:২৬ AM

সৌদি আরব ২০৩০ সালের ওয়ার্ল্ড এক্সপো এবং ২০৩৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। ‘ভিশন ২০৩০’ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশটি স্মার্ট শহর, আধুনিক বিমানবন্দর, মেট্রো রেল, মহাসড়ক, স্টেডিয়াম, হোটেল এবং ডিজিটাল অবকাঠামো নির্মাণে শত শত বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। এই মহাপরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো সৌদি আরবকে বিশ্বব্যাপী পর্যটন, খেলাধুলা এবং উদ্ভাবনের কেন্দ্রে পরিণত করা।

নির্মাণ ও সেবা খাতে এই ব্যাপক উদ্যোগ ব্যাপক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তৈরি করছে, যা বহুজাতিক কোম্পানি ও বিপুল সংখ্যক পর্যটককে আকৃষ্ট করবে। শ্রমশক্তি রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সামনে এটি একটি বড় সুযোগ হয়ে এলেও, সেই সুযোগ কাজে লাগাতে দেশটি কতটা প্রস্তুত—সে প্রশ্ন এখনো থেকেই যাচ্ছে।

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশি কর্মীরা সৌদি শ্রমবাজারের বড় একটি অংশ দখলে রেখেছে। কিন্তু এখন দেশটি আধুনিকায়নের পথে। ফলে শ্রমবাজারে চাহিদাও পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন ইংরেজি ও আরবি ভাষাজ্ঞান, আন্তর্জাতিক মানের সফট স্কিল এবং উন্নত কারিগরি দক্ষতা অপরিহার্য – যেখানে বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি আরব এখন উচ্চদক্ষতা সম্পন্ন শ্রমিক চায়। ইতোমধ্যেই তথ্য প্রযুক্তি ও উচ্চ বেতনের পেশার জায়গা দখল করছে অটোমেশন। এমনকি ক্লিনিং ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজও নিকট ভবিষ্যতে মেশিন দিয়ে করা হতে পারে।

তবে চাকরির বাজারে বাংলাদেশিদের জন্য নতুন এক উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে সৌদি আরবের জাতীয়করণ প্রকল্পসমূহ। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত "নীতাকাত" কর্মসূচি, যা শ্রমবাজারে বড় ধরনের রূপান্তর আনছে।

এর আওতায় ইলেকট্রনিক্স থেকে শুরু করে স্বর্ণালঙ্কারের দোকান পর্যন্ত অনেক খাতে এখন শতভাগ সৌদি নাগরিক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এমনকি হেলপার বা সহকারীর মতো অদক্ষ পদের ক্ষেত্রেও—প্রতি ১০ জন বিদেশি শ্রমিকের বিপরীতে অন্তত একজন সৌদি নাগরিক নিয়োগ দেওয়া কোম্পানিগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই কড়াকড়ির ফলে ধীরে ধীরে অদক্ষ বিদেশি শ্রমিকদের স্থান সংকুচিত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহু বাংলাদেশি শ্রমিক 'তাকামুল' স্কিল সার্টিফিকেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারছে না, যা এখন অনেক সেক্টরে ভিসা পাওয়ার পূর্বশর্ত। যদি এটি সব খাতে প্রযোজ্য হয়, তবে প্রতিবছর সৌদিতে যাওয়া ৫-৬ লাখ বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা কমে ৫০ হাজারে নেমে আসতে পারে।

সৌদি শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ হ্রাস পেতে পারে— বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে এমন শঙ্কা উঠলেও জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিষয়টিকে দেখছেন অনেক বেশি আশাবাদের চোখে।

তিনি বলেন, "আমি মনে করি না সৌদি আরব আমাদের কর্মীদের জন্য কাজের সুযোগ কমিয়ে দেবে। তারা বাংলাদেশিদের ওপর আস্থা রাখে। আমাদের সঙ্গে সৌদি আরবের একটি গভীর সাংস্কৃতিক বন্ধন আছে, এবং তাদের নিয়োগকারীরাও আমাদের কর্মীদের নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।"

তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ এখন প্রো-অ্যাকটিভ (আগাম) পদক্ষেপ নিচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে নতুন দক্ষতা যাচাইকরণ কর্মসূচি চালু—যা সৌদি আরবের পরিবর্তনশীল শ্রমবাজারের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে।

তবে, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, যদি সৌদি বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নের, ভাষা শিক্ষা ও শ্রমবাজার বৈচিত্র্যকরণসহ জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত এবং দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়—তাহলে বাংলাদেশ সেই ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা হারাতে পারে, যেখানে একসময় অনেকটাই আধিপত্য বজায় করতো।

সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাজার হিসেবে পরিচিত, আর তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে পরিসংখ্যানেই।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছেন ৫.২৬ লাখ বাংলাদেশি কর্মী। আগের বছরগুলোতেও এই সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য—২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ লাখ ৫২ হাজার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ৫৩ হাজার । বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে মোট ৪৫ লাখ প্রবাসী কর্মীর প্রায় ৫৭ শতাংশ-ই গেছেন সৌদি আরবে।

তবে এই বিপুল সংখ্যক কর্মীপ্রেরণ মূলত স্বল্প দক্ষ কাজ বা লো-স্কিলড জব-কেন্দ্রিক। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সৌদিতে প্রেরিত শ্রমিকদের ৮০ শতাংশের বেশি স্বল্প দক্ষতার পেশায় নিয়োজিত। অনানুষ্ঠানিক হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ৩০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি সৌদি আরবে কর্মরত রয়েছেন, যা বাংলাদেশের জন্য এখনো একক বৃহত্তম বৈদেশিক শ্রমবাজার।

কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হলো, এত বিপুল বাংলাদেশি কর্মী থাকা সত্ত্বেও সৌদি আরব থেকে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাচ্ছে, যা এই ইঙ্গিত দেয় যে স্বল্প দক্ষ কর্মীদের বিষয়ে সৌদি সরকারের কড়াকড়ি বাংলাদেশি কর্মীদের ওপর চাপ ফেলছে।

অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক অভিযোগ করছেন, তাদের 'ইকামা' (বসবাস ও কাজের অনুমতিপত্র) নবায়ন করা হচ্ছে না, কিংবা নবায়নের জন্য উচ্চ হারে ফি চাওয়া হচ্ছে, যা অনেকের পক্ষে বহন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে আরও বেশিদিন অবস্থানের চেষ্টাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রেমিট্যান্সের তথ্যেও এই প্রবণতা স্পষ্ট: ২০২০-২১ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স আসে ৫.৭২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে নেমে দাঁড়ায় ৪.৫৪ বিলিয়ন ডলারে। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা আরও কমে ৩.৭৭ বিলিয়ন ডলারে, এবং সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রেমিট্যান্স আরও হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২.৭৪ বিলিয়ন ডলারে।

২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উদ্যোগে যাত্রা শুরু করা 'ভিশন ২০৩০' একটি সুদূরপ্রসারী কৌশলগত রূপরেখা, যার মূল লক্ষ্য সৌদির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য আনা।

আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক পরামর্শক সংস্থা– সেন্টুরো গ্লোবাল জানিয়েছে, এই উদ্যোগের মাধ্যমে সৌদি আরব জ্বালানি তেল খাত থেকে নির্ভরতা কমিয়ে আনতে, সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খাতকে উন্নয়নের আওতায় আনতে কাজ করছে।

সৌদি আরব ২০২২ সালে যেখানে জিডিপির মাত্র ০.৭ শতাংশ ছিল বৈদেশিক বিনিয়োগ, সেখানে ভিশন ২০৩০-এর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে তা বিভিন্ন খাতে বাড়িয়ে ৫.৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়েছে। অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে বিপুল বিনিয়োগও করছে দেশটির সরকার।

এই রূপান্তরের ফলে বিশেষ করে গ্রিন এনার্জি, আইটি, স্বাস্থ্যসেবা, লজিস্টিকস ও পর্যটন খাতে দক্ষ পেশাজীবীদের চাহিদা বাড়ছে।

ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০৩০ এবং ফিফা বিশ্বকাপ ২০৩৪ আয়োজনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে, সৌদি আরব যখন তার ভিশন ২০৩০ পরিকল্পনার আওতায়—বড় পরিসরের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প শুরু করেছে, তখন এই রূপান্তরের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করছেন অভিবাসী শ্রমিকরাই।

মিক্সড মাইগ্রেশন সেন্টার-এর তথ্যমতে, বর্তমানে দেশটির বেসরকারি খাতে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ কর্মী কাজ করছেন, যার বেশিরভাগই বিদেশি। সৌদি অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে অবদান রাখছেন তারা।

সৌদি আরবের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আমালা, আল উলা, জেদ্দা টাওয়ার এবং দিরিয়াহ, যেগুলো আগামী এক দশকে দক্ষ নির্মাণশ্রমিক থেকে শুরু করে স্থপতি ও প্রকৌশলীসহ আনুমানিক ২০ লাখ নতুন চাকরি সৃষ্টি করতে পারে।

তাছাড়া, রেড সি প্রজেক্ট এবং কিদ্দিয়া এন্টারটেইনমেন্ট হাব-এর মতো উচ্চমানের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে পর্যটন ও আতিথেয়তা খাতে ২০৩০ সালের মধ্যে ৭০ হাজার পর্যন্ত চাকরি তৈরি হতে পারে – হোটেল ম্যানেজার, রন্ধনশিল্পী, ট্যুর গাইড এবং ইভেন্ট প্ল্যানারদের জন্য।

শ্রমবাজারে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়নে গতি আনতে সৌদি সরকার নতুন এক্সপ্যাট্রিয়েট ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম চালু করেছে। সৌদি প্রেস এজেন্সির (এসপিএ) বরাতে জানা গেছে, বিদেশি কর্মীদের এখন থেকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হবে—উচ্চ দক্ষ, দক্ষ এবং সাধারণ—যা নির্ধারিত হবে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, বয়স ও মজুরি অনুযায়ী।

এই নতুন ব্যবস্থাটি ১ জুলাই থেকে নতুন প্রবাসীদের জন্য কার্যকর হয়েছে, এবং ১৮ জুন থেকে সেখানে অবস্থানরত বা পুরনো কর্মীদের পুনঃশ্রেণিবিন্যাস শুরু হয়েছে।

এই সংস্কার সৌদি আরবের নিওম, রেড সি প্রজেক্ট, কিদ্দিয়া ও দিরিয়াহ গেট-এর মতো গিগা-প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এসব প্রকল্পে উচ্চ দক্ষ প্রকৌশলী, নির্মাণ কর্মী, পর্যটন ও প্রযুক্তি খাতে দক্ষ পেশাজীবীদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

সৌদি আরবের মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, "এই ব্যবস্থা প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, বৈশ্বিক প্রতিভা আকর্ষণ, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা গ্রহণ, উদ্ভাবন এবং ব্যবসার অগ্রগতিতে সহায়ক হবে।"