নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দেবে রাজনৈতিক দলগুলো
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈটিক দল। প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে গতকাল সোমবার (১২ আগস্ট) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ‘যমুনা’য় অনুষ্ঠিত এই মতবিনিময়ে বিএনপি, জামায়াতসহ প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দলই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দেওয়ার কথা জানিয়েছে। একই সঙ্গে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনায় না বসতে এবং দলটিকে এখন কোনো ছাড় বা স্পেস না দেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি এবং এনডিএমসহ কয়েকটি দল।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বিকালে প্রথমে বৈঠক করেন বিএনপির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে। এরপর জামায়াত ও অন্য কয়েকটি দলের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করেন তিনি। জানা গেছে, বৈঠকের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেখে সরকারের করণীয় সম্পর্কে দলগুলোর পরামর্শ জানতে চান।
প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধিদল নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলেনি। নির্বাচনের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা সরকারকে সময় দিচ্ছেন। তিনি বলেন, আগেও বলেছি- নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে কিছু সময় লাগবে। আমরা তাদের অবশ্যই সেই সময় দিচ্ছি। আমরা তাদের সব বিষয়কে সমর্থন দিচ্ছি।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা একটা কথা খুব পরিষ্কারভাবে বলেছি— বর্তমানে দেশে যে অস্থিরতার চেষ্টা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা, সাম্প্রদায়িকতার ধোঁয়া তোলা হচ্ছে, এগুলোতে জনগণ যাতে বিভ্রান্ত না হন। জনগণ যাতে আগের মতো ধর্মীয় সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন রেখে, জনগণের নিরাপত্তাকে অক্ষুণ্ন রেখে সরকারকে সহায়তা করেন। আমরা পুরোপুরিভাবে সেভাবে সহায়তা করছি। তিনি বলেন, গণতন্ত্র হত্যাকারী, ফ্যাসিস্ট সরকার মানুষের ওপর দীর্ঘদিন অত্যাচার, নির্যাতন চালিয়ে মানুষকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে তার থেকে মুক্তি পেয়ে মুক্ত পরিবেশে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম বসেছেন বিএনপির নেতাদের সঙ্গে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কী কী করা যায়—সে বিষয়ে তারা মতামত দিয়েছেন। সরকারও তাদের মতামত জানিয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, এখন মনে করি সরকারকে সহায়তা করা প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের একমাত্র কর্তব্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে মহলটি, যারা মানুষের অধিকার হরণ করেছিল, তারা আবার বাইরে থেকে, এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে ভারতে অবস্থান নিয়ে, সেখান থেকে বাংলাদেশের বিজয় নস্যাৎ করার চক্রান্ত করছে। আওয়ামী লীগকে ইঙ্গিত করে মির্জা ফখরুল বলেন, দুর্ভাগ্যজনক, এত হত্যা-নির্যাতনের পরও সেই দলটি আবারও বিভিন্ন রকম কথা বলছে। তিনি মনে করেন, এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সব দলের সঙ্গে সরকারের কথা বলা প্রয়োজন, কিন্তু হত্যাকারীর সঙ্গে নয়। যারা ছাত্রকে হত্যা করেছে, যারা শিশুকে হত্যা করেছে, যারা রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে জনগণ আছে এবং এ ব্যাপারে সরকার ব্যবস্থা নিতে গেলে অবশ্যই সহযোগিতা করা হবে।
মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের আরও বলেন, আমরা একটা কথা খুব স্পষ্ট করে বলেছি, তথাকথিত মাইনরিটির ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের যে গল্প ফাঁদা হয়েছে, সে গল্পটা পুরোপুরি উদ্দেশ্যমূলক। বাংলাদেশকে ম্যালাইন করা, এই সরকারকে ম্যালাইন করা, ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে একেবারে নস্যাৎ করে দেওয়ার আরেকটি চক্রান্ত।
বিএনপির সঙ্গে মতবিনিময় চলাকালেই যমুনায় প্রবেশ করে জামায়াতের প্রতিনিধিদল। বৈঠক শেষে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার প্রজ্ঞাপন বহাল থাকা সম্পর্কিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, জাতি এই মতলব বুঝে, জাতি এটা গ্রহণ করেনি। গ্রহণ করেনি বলেই রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ স্তরে এখন জামায়াতে ইসলামী সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা এটাকেই সবচেয়ে বড় বৈধতা মনে করি। এর চেয়ে বড় বৈধতা আমাদের প্রয়োজন নেই। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জামায়াত নেতা ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, আনম শামসুল ইসলাম ও মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রমুখ।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আপনারা কোনো পরামর্শ দিয়েছেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াত আমির বলেন, আমরা আমাদের সংগত জায়গা থেকে যেটা বুঝেছি, সেটা দিয়েছি। অবশ্যই আমরা সহযোগিতা করতে চাই। তিনি বলেন, সরকার শুরু হলো, আস্থা কেন রাখব না? এটা তো জনগণের বিপ্লবের সরকার। এখনই আস্থা হারিয়ে ফেলার মতো তো কোনো জিনিস আমরা দেখছি না। প্রসঙ্গত, সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল।
এরপর এবি পার্টি, এনডিএম, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদের দুই অংশ, সিপিবি, বাসদ, গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ ইত্তেফাককে বলেন, আমরা সরকারকে বলেছি—আওয়ামী লীগকে যেন কোনো লিগ্যাসি দেওয়া না হয়, ঐ দলটির সঙ্গে যেন কোনো আলোচনা না করে। এমনকি এবার ১৫ আগস্ট পালন না করার জন্যও পরামর্শ দিয়েছি। এছাড়া ভোট ডাকাতির সঙ্গে জড়িতদের অপসারণ করতে বলেছি। বিতর্কিত সচিব, ডিসি, এসপিদের সরানোর কথাও বলেছি। সম্ভব হলে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত নির্বাচন কমিশন গঠন আইনটি বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছি।
আরেক প্রশ্নের জবাবে ববি হাজ্জাজ বলেন, নির্বাচন কখন হবে এনিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। তবে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন যে, এ ধরনের মতবিনিময় চলমান থাকবে। সময়ে-সময়ে প্রয়োজনে তিনি দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে পরামর্শ নেবেন।