সংবিধান সংস্কার : দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের সুপারিশ
সংবিধান সংস্কার কমিশনের মতবিনিময় সভায় প্রস্তাব বাংলাদেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু করার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের দাবি অনেকটা জোরালো হয়ে উঠেছে এখন। আলোচনায় এবং লিখিতভাবে বিভিন্ন দল, সংগঠন ও শ্রেণি-পেশার মানুষ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলেছেন। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনে দেওয়া প্রস্তাবেও এমন সুপাৃরিশ করেছেন অনেক দল।
গত ৫ ডিসেম্বর সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের যৌথ মতবিনিময় সভায় অন্য কিছু প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠাকে ‘কমন প্রস্তাব’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রস্তাবটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনার কথা জানিয়েছেন দুই কমিশনের সদস্যরা। আরও সভা করে প্রস্তাবটির বিষয়ে চূড়ান্ত মত দেওয়ার কথাও জানান তারা।
এ প্রসঙ্গে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ও লিখিত প্রস্তাবে বিভিন্ন মহল থেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অনেকেই এমন প্রস্তাব করেছেন। এ প্রস্তাবের ভিত্তি, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সঙ্গে আমাদের এক ধরনের ঐকমত্যও রয়েছে। সবাই চাইছেন, এর মধ্য দিয়ে যেন ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ রোধ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়;
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হয় এবং জনগণের বৈচিত্র্যময় প্রতিনিধিত্বের প্রতিফলন যেন ঘটানো যায়। ফলে আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েই এ প্রস্তাবকে বিবেচনা করছি।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদারও বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদসহ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ে অনেকেই অভিন্ন মত দিয়েছেন। দুই কমিশন আবার বসে বিষয়গুলোকে কীভাবে বিবেচনায় আনা যায়, সেটা ঠিক করবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু আছে সেসব দেশেই, যারা সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য নতুন হলেও ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ৮০টির বেশি দেশে এমন ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে জাতীয় আইনসভার প্রায় ৪০ শতাংশ দ্বিকক্ষ এবং ৬০ শতাংশ এক কক্ষবিশিষ্ট। বাংলাদেশে এমন ব্যবস্থা চালু করতে কোন কক্ষে কীভাবে নির্বাচন হবে, সেটা নির্ধারণ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশসহ ১২১টি দেশের সংবিধান পর্যবেক্ষণ করেছি। ওইসব দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ আছে কিনা, থাকলে কীভাবে আছে কিংবা এটাতে কী ধরনের সুবিধা তৈরি হয় বা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়, সেগুলো আমরা বিবেচনায় এনেছি। কিন্তু শেষ বিচারটা হচ্ছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্লেষণ এবং সর্বোপরি জনগণের আকাঙ্ক্ষা বিবেচনায় নিয়েই আমরা যথাযথ সুপারিশ করব।’
কার ভাবনায় কীভাবে
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর দাবিকে সামনে নিয়ে আসা দল ও সংগঠনের নেতারা বলছেন, এ ধরনের সংসদ দেশে সুশাসন, জবাবদিহি ও গণতন্ত্র সুসংহত করে। এতে আইনসভায় সুশীলসমাজ ও দলীয় একাধিক ব্যক্তিকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করার সুযোগও সৃষ্টি হয়। ফলে বাংলাদেশে এটি চালু করা গেলে সেটা সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
এমন ভাবনার পক্ষে মত রয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিরও। সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় গত বছর দলটির পক্ষ থেকে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর অন্যতম প্রস্তাব হলো দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠা। সম্প্রতি সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনে দেওয়া লিখিত প্রস্তাবেও এমন সংসদ প্রতিষ্ঠাকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছে দলটি।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি ঢাকা বিভাগের বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীর উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে সংবিধানে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিষয় সংযুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জনগণের সমর্থন নিয়ে বিএনপি আগামীতে জাতীয় সরকার ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনা ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট সংবিধানে সংযুক্ত দেখতে চায়।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, ‘আমরা মনে করছি, যেসব যোগ্য ব্যক্তি আইন প্রণয়ন ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন, তাদের সংসদে আসা দরকার। এমন ব্যক্তিদের মধ্যে নারী, সংস্কৃতিকর্মী, সংবাদকর্মী ও সাহিত্যিক আছেন। তারা নির্বাচন করতে পারেন না, কিন্তু দেশে নানা ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অংশগ্রহণ করতে পারেন। তাদের নিয়ে চিন্তা থেকেই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব করেছে বিএনপি।’
এদিকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আব্দুর রব তিন দশকের বেশি সময় ধরে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের ১০ দফা প্রস্তাবে দেশকে আটটি প্রদেশে বিভক্ত করে এ আইনসভা চালুর দাবি রয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কাছে দেওয়া প্রস্তাবেও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে জেএসডি।
আ স ম আব্দুর রব বলেন, সংসদের নিম্নকক্ষ হবে ৩০০ সদস্যবিশিষ্ট। এতে থাকবেন নির্বাচনে বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত আসনের আনুপাতিক প্রতিনিধি। থাকবেন প্রবাসী, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত, বিভিন্ন প্রাদেশিক পরিষদের (গঠনের পর) প্রতিনিধি, নারী ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধিরাও। আর ২০০ সদস্যবিশিষ্ট উচ্চকক্ষে থাকবেন অদলীয়ভাবে নির্বাচিত বিভিন্ন শ্রম ও পেশার প্রতিনিধিরা।
অনেক চিন্তাবিদ ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধি দেশে এ ব্যবস্থা প্রচলনের জন্য আগে থেকে দাবি জানিয়ে আসছেন। তারা বলছেন, এটি শুধু সময়ের দাবিই নয়, আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনা ও সুষ্ঠু ধারার রাজনীতির জন্য অত্যাবশ্যক। উপমহাদেশ ও সার্ক দেশগুলোকেও বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে মালদ্বীপ ও বাংলাদেশ ছাড়া অন্য সব দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ আছে।
গত শনিবার ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত জাতীয় সংলাপে সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বাংলাদেশে অবশ্যই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা হতে হবে। সংসদে বিভিন্ন মতের মানুষ আসবেন, যারা নির্বাচনের জন্য গাইডলাইন তৈরি করতে পারেন। এতে আলাদা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনও হবে না।
এই বিষয়ে বিরোধিতাও রয়েছে
তবে দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাও করছে অনেক দল ও সংগঠন। তাদের যুক্তি, প্রতিবেশী ভারতসহ যেসব দেশে এমন আইনসভা কার্যকর রয়েছে, সেসব দেশ বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক থেকে অনেক বড়। ওইসব দেশে প্রাদেশিক সরকার রয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে ছোট, এখানে প্রাদেশিক ব্যবস্থা নেই। শুধু প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য ভৌগোলিকভাবে দেশকে আটটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে।
দেশের বামপন্থি দলগুলোর বেশির ভাগই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ বিষয়ে তেমন আগ্রহী নয়। তারা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সরব রয়েছে। সম্প্রতি সংবিধান ও নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের বৈঠকেও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন চালুর প্রস্তাব তুলে ধরেছে দলগুলো। বাম গণতান্ত্রিক জোট ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা এবং এসব জোটের বাইরে থাকা বামপন্থি বেশ কিছু দল থেকে লিখিতভাবে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন চালুর প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। এসব দলের মধ্যে আছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ জাসদও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘কেউ কেউ দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলেন। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটা তেমন কার্যকর হবে না বলেই আমরা মনে করি। কেননা এদেশে প্রাদেশিক সরকার নেই। দেশের বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু বা অন্য সংখ্যালঘুদের অবস্থানও এমন নয়, আইনসভায় তাদের অনেকের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। সুতরাং এই মুহূর্তে আমরা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করছি না।’ তিনি বলেন, দেশের আর্থিক কাঠামো, অবয়ব ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে তারা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিকে গুরুত্ব দেন। এরপরও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ বা অন্যান্য বিষয় টেবিলে এলে খোলা মন নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে প্রস্তুত তারা।
সোর্স : সমকাল/দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের সুপারিশ আসছে