কারাগারে পুতিনবিরোধী নেতা নাভালনির মৃত্যু; বিশ্বজুড়ে শোক
কারাবন্দী রাশিয়ার বিরোধী নেতা অ্যালেক্সাই নাভালনির মৃত্যু হয়েছে। তিনি দেশটির ইয়ামালো-নেনেটস অঞ্চলের কারাগারে সাজাভোগ করছিলেন।
যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪৭ বছর বয়সী নাভালনি পুতিনের অন্যতম দৃশ্যমান ও অবিচল সমালোচক ছিলেন। তিনি আর্কটিক সার্কেলের প্রায় ৪০ মাইল উত্তরে একটি কারাগারে বন্দী ছিলেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে অ্যালেক্সাই নাভালনিকে মস্কো থেকে ১৯০০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে উত্তরের শহর খার্পের আইকে–৩ পেনাল কলোনিতে স্থানান্তর করা হয়, যা ‘পোলার উলফ’ নামে পরিচিত। পেনাল কলোনি হচ্ছে এক ধরনের বসতি যেখানে কারাবাসীদের নির্বাসনে দেওয়া হয় এবং তাদের একটি দুর্গম জায়গা বা দ্বীপে রাখার মাধ্যমে বাকি জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করা হয়।
আইকে–৩ পেনাল কলোনি তথা কারাগারটিকে রাশিয়ার সবচেয়ে কঠোর কারাগার বলে মনে করা হয়, যেখানে বেশিরভাগ বন্দীকে গুরুতর অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, নাভালনিকে রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা মনে করা হতো। তিনি ২০২১ সাল থেকে কারাগারে আটক ছিলেন।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরোধী ও সমালোচকদের অনেকেরই রহস্যময় মৃত্যু হয়েছে। এবার এই তালিকায় যুক্ত হলো আরেকটি নাম, অ্যালেক্সাই নাভালনি। গতকাল শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) কারাগারে মারা গেছেন এই নেতা। এর আগে গত বছরের আগস্টে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন ওয়াগনারের সাবেক প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, পুতিনের বিরোধিতা করার কারণেই এসব ব্যক্তির ওপর নেমে এসেছে খড়্গ।
এদিকে নাভালনি অসুস্থ হয়ে আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেননি বলে দাবি করেছেন তার স্ত্রী ইউলিয়া নাভালনায়া ও সমর্থকরা। একইসঙ্গে নাভালনির মৃত্যু সংবাদ সত্যি হয়ে থাকলে পরিকল্পিত খুনের দায়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তার নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ইউলিয়া।
নাভালনির স্ত্রী বলছেন, ‘আমি জানি না নাভালনির মৃত্যু সংবাদ সত্য কি না। আমরা পুতিন এবং তার নেতৃত্বাধীন প্রশাসনকে বিশ্বাস করতে পারি না। তারা সবসময় মিথ্যা বলে। তবে যদি এটি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে পুতিন, তার সব অনুগামী-অনুসারী, পুতিনের মিত্র এবং তার নেতৃত্বাধীন সরকারের সবাইকে এর দায় বহন করতে হবে। আমাদের দেশ, আমার পরিবার এবং আমার স্বামীর সঙ্গে তারা যা কিছু করেছে তার জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে তাদের।’
শুক্রবার জার্মানির মিউনিখ শহরে ইউরোপভিত্তিক জোট দাভোসের প্রতিরক্ষা বিষয়ক সম্মেলন শুরু হয়েছে। ‘দাভোস অব ডিফেন্স’ নামের তিন দিনের এই সম্মেলনে যোগ দিতে ইউরোপ এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে মিউনিখে উপস্থিত হয়েছেন শত শত রাজনীতিবিদ, সামরিক কর্মকর্তা এবং কূটনীতিক।
যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হলে ইসরায়েল ও ইউক্রেন যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে— এ নিয়ে ইতোমধ্যে দুশ্চিন্তায় পড়েছে ইউরোপ। দাভোস অব ডিফেন্স সম্মেলন আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য এটিই।
কিন্তু নাভালনির মৃত্যু সংবাদ সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়। সম্মেলন শুরুর দিন শুক্রবার নির্ধারিত আলোচানা স্থগিত রেখে ইউলিয়া নাভালনায়াকে মঞ্চে বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান জানান দাভোস অব ডিফেন্সের আয়োজকরা।
তিনি যখন বক্তব্য দেওয়ার জন্য মঞ্চে ওঠেন, সে সময় সম্মেলনে উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানান তাকে।
নাভালনায়া বলেন, ‘এখানে আসার আগে দীর্ঘ সময় ধরে আমি ভেবেছি যে আমার কি এখানে আসা উচিত, না কি শিগগিরই মস্কোতে আমার ছেলে মেয়েদের কাছে যাওয়া উচিত। কিন্তু তখন আমার মনে হলো, এই অবস্থায় অ্যালেএক্সি থাকলে কী করতেন। আমি নিশ্চিত, তিনি এই মঞ্চে উপস্থিত থাকতেন।’
রাশিয়ার বিরোধী দলীয় নেতা অ্যালেক্সাই নাভালনির মৃত্যুর জন্য রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে দায়ী করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি জানান, নাভালনির মৃত্যুর খবর তাঁকে বিস্মিত করেনি, তবে এতে তিনি ক্ষুব্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনও এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। কমলা বলেন, অ্যালেক্সি নাভালনির মৃত্যু সংবাদ যদি সত্য হয়, তাহলে এটি হবে পুতিনের নিষ্ঠুরতার আরও একটি উদাহারণ। যদি সত্যিই এটি ঘটে থাকে, তাহলে অবশ্যই রাশিয়া এর জন্য দায়ী— এটা আমরা স্পষ্টভাবে বলছি।
নাভালনির মৃত্যুতে শোক পালিত হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে। গত এক দশকে রাশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী বিরোধী এই নেতার মৃত্যুর খবরে নিউইয়র্ক, লন্ডন এবং জেনেভায় নাভালনির অস্থায়ী প্রতিকৃতি এবং ছবিতে ফুল ও মোমবাতি জ্বালিয়ে শোক জানানো হয়।
এছাড়া বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয় শোক র্যালি। বুলগেরিয়া, লিথুয়ানিয়াসহ বিভিন্ন দেশের রুশ দূতাবাসের সামনে চলছে শোক পালন।
অন্যদিকে, নিরাপত্তা বাহিনীর কড়াকড়ি আর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দূতাবাসের সামনে নাভালনির ছবি, ফুল আর মোম নিয়েও শোক জানানো হচ্ছে। এ সময় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে হত্যাকারী হিসেবে আখ্যা দেন তারা।
প্রসঙ্গত, গত বছরের শেষের দিকে রাশিয়ার আর্কটিক অঞ্চলের ইয়ামালো নেনত্স কারাগারে পাঠানো হয় নাভালনিকে। এই কারাগারটিকে রাশিয়ার সবচেয়ে কঠিন কারাগার বলে মনে করা হয়।
শুক্রবার এক বিবৃতিতে ইয়ামালো নেনত্স কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, ওইদিন সকালে কারাগারের ভেতর হাঁটার সময় হঠাৎ তিনি অসুস্থ বোধ করেন নাভালনি এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে কারা চিকিৎকদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়; তবে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক নাভালনিকে মৃত ঘোষণা করেন। ঠিক কী কারণে তার মৃত্যু হয়েছে, বিবৃতিতে তা স্পষ্ট করেনি কারা কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু অসুস্থতাজনিত কারণে নাভালনির মৃত্যু হয়েছে—সেকথা বিশ্বাস করতে পারছেন না তার মা ও স্ত্রীসহ অনেকেই। কারণ, মাত্র দুই দিন আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসে স্ত্রী ইউলিয়া নাভালনায়ার উদ্দেশে একটি আবেগপূর্ণ ভিডিওবার্তা দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তাকে বেশ হাসিখুশি ও প্রাণবন্ত মনে হয়েছে।
এছাড়া রুশ সংবাদপত্র নোভায়া গ্যাজেটের প্রতিবেদন অনুসারে, নাভালনির মা ল্যুডমিলা নাভালনায়া বলেছেন, গত ১২ ফেব্রুয়ারি যখন তিনি নাভালনিকে শেষবার দেখেছিলেন তখনও তিনি শতভাগ সুস্থ এবং হাসিখুশি ছিলেন।
নাভালনির সমর্থকদের একাংশের অভিযোগ, কারাগারে খুন করা হয়েছে নাভালনিকে এবং প্রশাসন সেটি আড়াল করতে অসুস্থতাজনিত আকস্মিক মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করছে।
নাভালনির প্রধান সহকারী লিওনিদ ভলকোভ বলেছেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রের প্রচারণা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। তার মৃ্ত্যুর খবর যদি সত্য হয়, তাহলে নাভালনি মরেননি। পুতিনই তাকে খুন করেছেন।’
উল্লেখ্য, রাশিয়ায় নাভালনিকেই একমাত্র বিরোধী নেতা বলে মনে করা হতো, যিনি সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিতে রাশিয়াজুড়ে বিপুল সংখ্যক মানুষকে একত্রিত করতে সক্ষম ছিলেন।
২০২০ সালেও তাকে সাইবেরিয়ায় বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। তবে সে যাত্রায় অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি। সে সময় পশ্চিমা দেশগুলো জানায় যে, তার ওপর স্নায়ুবিক এজেন্ট প্রয়োগ করা হয়েছিল।