ভারতীয় নার্সের মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক
আন্তর্জাতিক জার্নাল আন্তর্জাতিক জার্নাল
প্রকাশিত: ১৬ জুলাই ২০২৫, ০৯:১৭ AM

ইয়েমেনের নাগরিক তালাল আব্দো মাহদিকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ভারতীয় নার্স নিমিশা প্রিয়ার ফাঁসি স্থগিত করেছে দেশটির বিচার বিভাগ। আজ ১৬ জুলাই তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও, তার একদিন আগেই এই আদেশ স্থগিত করা হয়। বিষয়টি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে জানিয়েছে বিবিসি।

উল্লেখ্য, ইয়েমেনে ইসলামি শরিয়া আইন অনুসরণ করা হয়। এই আইনে, কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দোষী ব্যক্তির পরিবার যদি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ করে, তাহলে নিহত ব্যক্তির স্বজনেরা চাইলে অপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করতে পারেন। এই আর্থিক ক্ষতিপূরণকে ইংরেজিতে বলা হয় 'ব্লাড মানি' এবং আরবি ভাষায় একে বলা হয় 'দিয়াহ'। অভিযোগ প্রত্যাহার হলে মৃত্যুদণ্ডসহ অন্যান্য সাজাও বাতিল হয়ে যেতে পারে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সূত্রে জানা গেছে, নিমিশার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করা হয়েছে, বাতিল হয়নি। এই দণ্ডাদেশ বাতিলের পথ এখন একটাই— দিয়াহ। যদি তালাল আব্দো মাহদির পরিবারের সদস্যরা ‘দিয়াহ’ গ্রহণে সম্মত হন— কেবল তাহলেই বেঁচে যেতে পারেন নিমিশা।

কারণ এর আগে ইয়েমেনের সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করে সফল হননি নিমিশার আইনজীবীরা। তারপর ইয়েমেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহদি আল মাশাতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার করেছিলেন নিমিশা, কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হন।

নিমিশাকে বাঁচাতে কয়েক বছর আগে থেকেই আন্তর্জাতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। তার পরিবারের স্বজনারা জানিয়েছেন, তারা তালাল আব্দো মাহাদির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে প্রস্তুত এবং ইতোমধ্যে তারা ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১০ লাখ ডলার জোগাড় করেছেন। তালালের পরিবারের লোকজনদেরকে এ অর্থ অর্থ নেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছেন তারা।  ইয়েমেনে তার মামলা পরিচালনার দায়িত্বে আছে ‘সেভ নিমিশা প্রিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন কাউন্সিল’ নামের একটি সংস্থা।

তবে তালালের পরিবার এখনও ‘দিয়াহ’ গ্রহণে রাজি হয়নি। তালালের বড় ভাই আব্দেলফাত্তাহ মাহদি বিবিসিকে এ প্রসঙ্গে বলেন, "সমঝোতার ব্যাপারে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট; আমরা কিসাস (শরিয়া আইনের প্রধান ভিত্তি) আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের উপর জোর দিচ্ছি, অন্য কিছু নয়।”

আব্দেলফাত্তাহ মাহদি বলেন, তার পরিবারের সদ্যরা কেবল তালালের নির্মম মৃত্যুই নয়— গত ৪-৫ বছর চলমান এই মামলার বিচার কার্যক্রমে ক্লান্ত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

“আর আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে সত্যকে বিকৃত করার জন্য গত কয়েক বছরে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষ করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে আসামিকে ভিকটিম হিসেবে দেখানো হচ্ছে এবং এই অপরাধকে বৈধতা প্রদানের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা পরিষ্কারভাবে দেখছি যে জনমতের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।”

“যে কোনও বিরোধ, তার কারণ যাই হোক না কেন এবং যত বড়ই হোক না কেন, কোনও হত্যাকাণ্ডকে ন্যায্যতা দিতে পারে না - মৃতদেহ টুকরো টুকরো করা, বিকৃত করা এবং লুকিয়ে রাখা তো দূরের কথা।”

তবে ‘সেভ নিমিশা প্রিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন কাউন্সিল’ এখনও আশা ছাড়েনি। সংস্থাটির মুখপাত্র বাবু জন বলেছেন, “আমরা নিমিশাকে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, সরকারি পর্যায়ে ইয়েমেনের কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। এই যোগাযোগের ফলেই আপাতত স্থগিত হয়েছে নিমিশার দণ্ডাদেশ।

কেরালার পালাক্কর জেলার বাসিন্দা নিমিশা নার্স হিসেবে কাজ করার জন্য ২০০৮ সালে ইয়েমেনে গিয়েছিলেন।

ইয়েমেনে যাওয়ার পরে স্বামী টমি থমাস এবং মেয়ের সঙ্গেই থাকছিলেন নিমিশা। পরে ২০১৪ সালে তাঁর স্বামী এবং ১১ বছরের কন্যা ভারতে ফিরে এলেও নিমিশা ইয়েমেনেই থেকে যান। তাঁর ইচ্ছা ছিল, নিজের ক্লিনিক খুলবেন। ওই বছরই ইয়েমেনি নাগরিক তালাল আব্দো মাহদির সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁর। মাহদি তাঁকে নতুন ক্লিনিক খুলতে সাহায্য করবেন বলে আশ্বাস দেন। কারণ আইন অনুযায়ী, ইয়েমেনে নতুন ব্যবসা শুরু করতে গেলে দেশীয় অংশীদার রাখা বাধ্যতামূলক। সেইমতো ২০১৫ সালে দু’জন মিলে নতুন ক্লিনিক খোলেন। এর পর থেকেই শুরু হয় দুই অংশীদারের মতবিরোধ।

অভিযোগ, নিমিশার অর্থ এবং পাসপোর্ট মাহদি কেড়ে নিয়েছিলেন মাহদি। মারধর করে নিমিশাকে মাদকসেবনেও বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে মাহদির বিরুদ্ধে। আইনি কাগজপত্রে নিমিশাকে স্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিয়ে প্রশাসনিক সাহায্য পাওয়ার পথও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পুলিশের দ্বারস্থ হয়েও লাভ হয়নি।

এই পরিস্থিতিতে ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই মাহদিকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেন ওই নার্স। নিমিশার দাবি, মাহদিকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের পাসপোর্ট পুনরুদ্ধার করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। কিন্তু ওভারডোজ়ের কারণে মৃত্যু হয় মাহদির। এর পর হানান নামে এক সহকর্মীর সঙ্গে মিলে মাহদির দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে পানির ট্যাঙ্কে ফেলে দেন ওই নার্স। ওই মাসেই ইয়েমেন ছেড়ে পালানোর সময় ধরা পড়ে যান নিমিশা। সেই থেকে ইয়েমেনের জেলেই বন্দি রয়েছেন এই ভারতীয় নারী।

নিমিশার মা একজন দরিদ্র গৃহকর্মী। মেয়েকে রক্ষা করতে ২০১৪ সাল থেকে ইয়েমেনে আছেন তিনি।