ভারত-পাকিস্তান সামরিক শক্তিতে কে কতটা এগিয়ে?

ভারত ও পাকিস্তান—দুই চিরবৈরী প্রতিবেশী রাষ্ট্র। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই এই দুই দেশের মধ্যে শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছে। তারা এখন পর্যন্ত তিনবার বড় ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধের পর ১৯৯৯ সালে কারগিলে আবারও মুখোমুখি হয় তারা। এরপর বড় কোনো যুদ্ধ না হলেও, সীমান্ত এলাকাগুলোতে মাঝেমধ্যেই উত্তেজনা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি ২২ এপ্রিল, কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, দুই দেশ একরকম মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে—পরমাণু শক্তিধর এই দুই দেশের মধ্যে যদি সরাসরি যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে কার পাল্লা ভারী থাকবে? সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, যে দেশের সেনা, অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বেশি, সেই দেশই জিতবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধের ফলাফল শুধু এই উপাদানগুলোর ওপর নির্ভর করে না। যদিও সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ভারত এগিয়ে, তারপরও পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ হলে নিশ্চিত জয় পাওয়া ভারতের জন্যও সহজ নয়।

সমরশক্তির তুলনা নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্য বলছে, সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সশস্ত্র বাহিনীর অধিকারী, যেখানে পাকিস্তানের অবস্থান ১২তম। সামগ্রিক বিবেচনায় স্থলশক্তিতে ভারতের লোকবল ও সামরিক সরঞ্জাম বেশি থাকলেও এগিয়ে পাকিস্তান। এর কারণ নানাবিধ। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হলো পাকিস্তানের ভূপ্রকৃতি।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার-এর ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের সশস্ত্র বাহিনীতে সক্রিয় সদস্য রয়েছে ১৪ লাখ ৫০ হাজারের বেশি, যেখানে পাকিস্তানে এই সংখ্যা সাড়ে ৬ লাখের কিছু বেশি। রিজার্ভ বাহিনীর দিক থেকেও ভারত এগিয়ে—দেশটির রিজার্ভ সেনার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১১ লাখ, বিপরীতে পাকিস্তানের রয়েছে সাড়ে ৫ লাখের মতো। সামরিক বাহিনীর আকার এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতার দিক থেকেও ভারত বেশ এগিয়ে, যার ফলে তারা প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল বাজেট বরাদ্দ করতে পারে। ২০২৪ সালে ভারতের সামরিক বাজেট ছিল প্রায় ৭৫ বিলিয়ন ডলার, যেখানে পাকিস্তান ব্যয় করেছে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।

পাকিস্তানের বিমান সক্ষমতার ক্ষেত্রে মোট বিমান আছে ১ হাজার ৩৯৯, যার মধ্যে যুদ্ধবিমান আছে ৩২৮টি। তবে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান আছে ৪৫২ টি। বিপরীতে ভারতের মোট বিমান ২ হাজার ২২৯টি এবং যুদ্ধবিমান আছে ৫১৩টি। তবে রয়টার্সের তথ্য অনুসারে ভারতের যুদ্ধবিমান আছে ৭৩০টির মতো।

ভারতের অ্যাটাক হেলিকপ্টার আছে যেখানে ৮০টি, সেখানে পাকিস্তানের ৫৭টি। ভারতের ট্যাংক আছে ৪ হাজার ২০১টি, বিপরীতে পাকিস্তানের আছে ২ হাজার ৬২৭টি। ভারতের সেলফ প্রপেলড আর্টিলারি আছে ১০০টি, যেখানে পাকিস্তানের আছে ৬৬২টি। ভারতের টোয়েড আর্টিলারি আছে ৩ হাজার ৯৭৫টি এবং পাকিস্তানের আছে ২ হাজার ৬২৯টি।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আনুপাতিক সক্ষমতা বিবেচনায় ভারতের প্রায় কাছাকাছি হলেও নৌশক্তিতে পাকিস্তান বেশ খানিকটা পিছিয়েই আছে। ভারতের নৌবহরে মোট নৌযান আছে ২৯৩টি—এর মধ্যে দুটি বিমানবাহী রণতরি, ১৮টি সাবমেরিন, ডেস্ট্রয়ার ১৩টি, ফ্রিগেট ১৪টি, করভেট ১৮টি এবং টহল নৌযান ১৩৫টি। বিপরীতে পাকিস্তানের নৌবহরে মোট নৌযান আছে ১২১ টি। দেশটির কোনো বিমানবাহী রণতরি নেই, তবে ৮টি সাবমেরিন আছে। কোনো ডেস্ট্রয়ার না থাকলেও ফ্রিগেট ও করভেট আছে ৯টি করে। পাকিস্তানের টহল নৌযান আছে ৬৯টি। মাইন ওয়ারফেয়ারের ক্ষেত্রে ভারতের সক্ষমতা শূন্য, পাকিস্তানের নৌযান আছে ৩টি।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সব সময় লোকবল ও সরঞ্জামই একটি সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা তুলে ধরে না। মার্কিন থিংক ট্যাংক কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশনসের ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র ফেলো মানজারি চ্যাটার্জি মিলার নিউজউইককে বলেন, ভারতের সামরিক বাজেট ও সক্ষমতা পাকিস্তানের চেয়ে ‘অনেক বেশি’ হলেও এটি মূল সমস্যা নয়। তিনি বলেন, ‘আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, যুদ্ধের ক্ষেত্রে উভয় দেশের সামরিক বাহিনী উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করতে এবং ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটাতে পারে কি না এবং এর উত্তর দ্ব্যর্থহীনভাবে হ্যাঁ।’

যুক্তরাষ্ট্রের সেলেম স্টেট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক কানিষ্কম সাতশিভম নিউজউইককে বলেন, জনসংখ্যা ও জিডিপির ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা থাকলেও দুই দেশের সামরিক শক্তি ‘ততটা ভিন্ন নয়’। তিনি জানান, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পরাজয়ের পর পাকিস্তান নিশ্চিত করেছে যে তাদের সক্ষমতা ‘অন্তত ভারতের সমপর্যায়ে’ থাকবে।

কানিষ্কম সাতাশিভম বলেন, ‘জনশক্তি এবং গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামের হিসাবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আকার ভারতের চেয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ ছোট। তবে, পাকিস্তানের প্রায় পুরো সেনাবাহিনীই ভারতের বিরুদ্ধে মোতায়েন করা। অন্যদিকে ভারতের সেনাবাহিনী পূর্বে চীনের দিকেও মোতায়েন রয়েছে।’ ফলে পাকিস্তান সীমান্তে ভারতের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিতে পারবে বলে তিনি জানান।

মিলার বলেন, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও জনগণের চাপের মুখে ভারতের ‘শিগগিরই পাল্টা আঘাত হানা ছাড়া উপায় নেই।’ জনগণ একটি ‘কড়া জবাব’ চাইছে। পরিস্থিতি শান্ত করা কঠিন। উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু কাশ্মীর, দুই দেশের নেতাদের কঠোর ভাষা ও যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক খারাপ হওয়া পরিস্থিতিকে ‘বিস্ফোরক’ করে তুলেছে বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, ‘দুটি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক সংঘাতের ক্ষেত্রে পারমাণবিক উদ্বেগ সব সময়ই বৈধ। তবে, কেউ কেউ মনে করেন, অতীতে পারমাণবিক উদ্বেগই ভারত-পাকিস্তানকে সংযত রেখেছে। এটি উভয়কে কেবল সীমিত সংঘাতে জড়াতে বাধ্য করেছে।’

সাতাশিভম বলেন, তিনি এই পরিস্থিতি নিয়ে ‘খুব উদ্বিগ্ন’। তিনি পাকিস্তানের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের ‘অদ্ভুতভাবে যুদ্ধংদেহী হয়ে ওঠা মনোভাবের’ দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, ‘যদি পাকিস্তানের ওপর ভারতীয় হামলায় তাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ দ্রুত ভেঙে পড়ে এবং ভারত পাকিস্তানের ভূখণ্ডের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়, তাহলে পাকিস্তানিরা ভারতীয় অগ্রগতি থামাতে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে অত্যন্ত উৎসাহিত হবে।’

তথ্যসূত্র: নিউজউইক, রয়টার্স, ইউএসনিউজ ও গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার