এই পাঠে জানুন:
এক পলকে খতনা বা মুসলমানির সম্পর্কে
পুরুষাঙ্গের সামনের বা মাথার দিকে যে অতিরিক্ত চামড়া পুরুষাঙ্গের সংবেদনশীল মাথাকে ঢেকে রাখে, তা কেটে বাদ দেওয়াকেই বলা হয় খতনা বা মুসলমানি। মেডিক্যাল টার্মে একে বলে সারকামসিশন। সারকামসিশন শব্দটি এসেছে লাতিন সারকামডায়ার থেকে, যার অর্থ হলো চারদিক থেকে কেটে ফেলা। মুসলিম জাতি ছাড়াও অন্য ধর্মাবলম্বীরাও খতনা দিয়ে থাকে।
একটা দীর্ঘসময় ধরে এই কাজ বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে হাজামরা করে এসেছেন। তবে এখন হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা সার্জারির মাধ্যমে খৎনা করার চল বেড়েছে। বর্তমানে কিছু ডিভাইস, এমনকি লেজারের মাধ্যমেও খতনার সার্জারি হচ্ছে। লোকাল অ্যানেসথেসিয়া বা জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে এই অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে। তবে অবশ্যই চিকিৎসক প্রশিক্ষিত কি না, সেটা জেনে নেওয়া জরুরি।
ইসলামের দৃষ্টিতে খৎনা
মুসলিম সমাজে এ সংস্কৃতি শত শত বছর ধরে চলে আসছে। এটি একটি মহান সুন্নত। যুগে যুগে বড় বড় নবী-রাসুলও এ সুন্নত পালন করেছেন। সর্বপ্রথম এ সুন্নত পালন করেছেন হজরত ইবরাহিম (আ.)।
হজরত সাইদ ইবনে মুসাইয়াব (রহ.) থেকে বর্ণিত, হজরত ইবরাহিম (আ.) হলেন খতনার সুন্নত পালনকারী সর্বপ্রথম ব্যক্তি। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ২৬৪৬৭)
কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম (আ.)-কে তাঁর রব কয়েকটি বাণী দিয়ে পরীক্ষা করেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করেন। তিনি বলেন, আমি তোমাকে মানুষের জন্য নেতা বানাব। সে বলল, আমার বংশধরদের থেকেও? তিনি বলেন, জালিমরা আমার ওয়াদাপ্রাপ্ত হয় না। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১২৪)
কেন খৎনা বা মুসলমানি করা হয়?
সাধারণত ধর্মীয় রীতি অনুসারে মুসলিম ছেলে শিশুদের এটি করা হয়। কিছু কিছু জন্মগত রোগেও সাকামসিশন করার নির্দেশনা আছে। এর মধ্যে আছে— যাদের লিঙ্গের অগ্রভাগের ছিদ্র ছোট থাকে, বারবার তাদের প্রস্রাবে সংক্রমণ হতে পারে; যাদের চামড়া গ্লান্স লিঙ্গের পেছনে আটকে গিয়ে ব্যথা করে, তাদের ক্ষেত্রে এটি করা হয়; এই দুটি অবস্থার মেডিকেল টার্ম হলো ফাইমোসিস আর প্যারাফাইমোসিস।
কোন বয়সে খৎনা করানো উত্তম?
পশ্চিমা দেশে সাধারণত জন্মের পরপরই এটি করা হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে সাধারণত দেখা যায় যে, বাচ্চারা একটু বড় হলে তারপর তাদের খৎনা করা হয়ে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর কোনো নির্দিষ্ট বয়স না থাকলেও, বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় তিন বা চার বছর বয়স খৎনার উপযুক্ত সময় বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।
বেশি ছোট শিশুরা ভয় পায় ও কান্নাকাটি করে বেশি। আর বড়দের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার-পরবর্তী ইরেকশনের কারণে রক্তপাত হওয়ার শঙ্কা বেড়ে যায়। তবে শিশুর খতনা করানোর আগে বাড়ি থেকে তাকে সাহস দিন। তাকে না বলে, গোপন করে বা জোর করে খতনা করাতে গেলে সার্জারির সময় আঘাতজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
মুসলমানির জন্য সঠিক সময় হলো স্কুলে যাওয়ার আগে। তিন থেকে চার বছরের মধ্যে। যখন সে ডায়াপার ছেড়ে দেবে। তখনই করিয়ে নিতে পারলে সবচেয়ে ভালো। আর পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের চিকিৎসকদের একটি দল একমত হয়েছেন, এই সময়ের আগে করলে প্রস্রাবের রাস্তা সরু হয়ে যেতে পারে।
খৎনা করানোর আগে রক্ত পরীক্ষা করে নিন
খতনা করানোর আগে রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন আছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শুধু খতনা করানোর কারণেই অনেক রোগী রক্তপাতের ফলে মারা গেছে। অনেক শিশুর জন্মগত রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা থাকতে পারে। রক্ত পরীক্ষা না করে এ শিশুদের খতনা করালে একবার রক্তপাত শুরু হলে আর থামতেই চায় না। তাই খতনার আগে বাচ্চার অবশ্যই রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা (জন্মগত) আছে কি না, তা দেখে নিতে হবে।
খৎনার উপকারিতা
খতনা বা মুসলমানি করার কিছু উপকারী দিক রয়েছে। যেমন— মুসলমানি করালে মূত্রনালির সংক্রমণের ঝুঁকি কম হয়। কিছু যৌনবাহিত রোগের ঝুঁকিও হ্রাস করে; ব্যালানাইটিস (গ্লান্সের প্রদাহ), ব্যালানোপোস্টাইটিস (গ্লান্স ও ফরস্কিনের প্রদাহ) প্রভৃতি প্রতিরোধ করে; অনেক সময় পুরুষাঙ্গের মাথার দিকের চামড়া মূত্রনালিতে এমনভাবে লেগে থাকে যে প্রস্রাব ভালো মতো বের হতে পারে না। তখন প্রস্রাবের নালিতে ইনফেকশন বা কিডনিতে জটিলতা হতে পারে।
মুসলমানি করালে ফাইমোসিস হয় না; পুরুষাঙ্গের মাথার দিকের চামড়া উল্টে শক্ত হয়ে গেলে ওই চামড়াকে আর সামনে ও পেছনের দিকে নড়াচড়া করা যায় না। তখন লিঙ্গের মাথা ফুলে যায়, রক্ত সঞ্চালন বাধাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু মুসলমানি করালে এই জটিলতা থেকে রক্ষা মেলে; পেনাইল ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা তৈরি করে খতনা। এ ছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষার জন্যও যেকোনো ধর্মের পুরুষরা খতনা করিয়ে থাকেন।
খতনার বৈজ্ঞানিক সুফল
পুরুষের খতনাকে আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত বলে মনে করেন। খতনার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ছত্রাকজাতীয় (ব্যাকটেরিয়া) রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। খতনার প্রধান সুবিধা হলো, এর ফলে লিঙ্গের অগ্র ত্বকে যে তরল জমে নোংরা অবস্থার সৃষ্টি করে, তা থেকে রেহাই পেতে পারে।
খতনার সুফল নিয়ে অস্ট্রেলীয় মেডিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক ড. ব্রায়ান মরিস চমৎকার গবেষণা করেছেন। তাতে উল্লেখ করা হয়, যেসব বালকের সারকামসিশন (খতনা) করা হয়নি, তাদের অপেক্ষাকৃত কিডনি, মূত্রথলি ও মূত্রনালির ইনফেকশন চার থেকে ১০ গুণ বেশি হয়। তিনি মনে করেন, সারকামসিশনের (খতনা) মাধ্যমে অন্তত এক-চতুর্থাংশ মূত্রনালির ইনফেকশন হ্রাস করা যায়।
যৌনবিজ্ঞানীরা বহুকাল আগে থেকেই বলে আসছেন যে পুরুষের খতনা করালে স্পর্শকাতরতা বেড়ে যায়। এতে যৌন মিলনে অধিক আনন্দ উপভোগ করে নারী-পুরুষ উভয়ই। বর্তমানে ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ ইউরোপেও প্রচুর পরিমাণে খতনা করানো হয়। সেখানে গুরুত্বের সঙ্গে এটা দেখা হয়।
খৎনা কখন করা যাবে না
প্রস্রাবের ছিদ্র নিচের দিকে থাকলে বা হাইপোস্পেডিয়াস হলে এবং ছিদ্র ওপরের দিকে থাকলে বা ইপিস্পেডিয়াস হলে খতনা করানো যাবে না। ওই অবস্থায় খতনা করালে ছিদ্রটি যথাস্থানে ফিরিয়ে আনা অনেক কঠিন হয়ে যায়; রক্তক্ষরণজনিত রোগ হিমোফিলিয়া হলে খতনা দেওয়া যাবে না। অনেকের রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা থাকে এবং সে কারণে অপারেশনের পর রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না।
খতনার পরবর্তী জটিলতা এড়াতে
লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে অস্ত্রোপচার করা হলে অনেক সময় লিঙ্গের গোড়া তিন-চার দিন ফোলা থাকতে পারে। এতে ভয়ের কিছু নেই। এ ছাড়া অস্ত্রোপচারের পরের এক সপ্তাহে ক্ষতস্থান থেকে অল্প রক্তমিশ্রিত পানির মতো তরল আসতে পারে। এটিও এমনিতেই সেরে যাবে। নিয়মিত কুসুম গরম পানিতে গোসল করলে ক্ষতস্থান দ্রুত সেরে ওঠে। অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সময় লুঙ্গি বা নরম ঢিলে কাপড় পরলে ব্যথা কম হয়। এক সপ্তাহের মধ্যেই ক্ষত সেরে গেলে স্বাভাবিক পোশাক পরে সব কাজ করা সম্ভব।
আরও কিছু পরামর্শ
দক্ষ চিকিৎসক বা সার্জন দ্বারাই খতনা করান। দক্ষ অবেদনবিদ দ্বারা সম্পূর্ণ ব্যথাবিহীন এবং নিরাপদ অপারেশন সম্ভব; হাজাম বা অনভিজ্ঞ কাউকে দিয়ে খতনা না করানোই ভালো। অনেক সময় অনভিজ্ঞতায় অতিরিক্ত বা কম চামড়া কেটে ফেললে সমস্যা তৈরি হয়। অনভিজ্ঞতায় লিঙ্গের সংবেদনশীল মাথা কেটে ফেললেও মারাত্মক জটিলতা তৈরি হয়; মুসলমানি দেওয়ার পরও কোনো কোনো শিশুর রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না। এটা মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করে বা মৃত্যুও ডেকে আনে। তাই খতনা করার আগে রক্ত পরীক্ষা করে দেখা উচিত রক্ত পড়া বন্ধ হতে বিলম্ব হয় কি না। মামাতো বা খালাতো ভাইদের এ রকম সমস্যা আছে কি না তাও জানা দরকার।