সমঝোতার পথে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ শুল্কারোপ নিয়ে আলোচনার জন্য বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থান করছে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আলোচনার চূড়ান্ত দফার দ্বিতীয় দিনের বৈঠক শেষে দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের মতপার্থক্য প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিরসন হয়েছে এবং আলোচনায় আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হয়েছে।
আলোচনায় থাকা একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত শুল্ক হার ও প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে একটি বাস্তবসম্মত এবং পরিপূর্ণ সমঝোতায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা এখন প্রবল।
বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাল্টা শুল্ক কমার বিষয়টি শুধু নিশ্চিতই নয়, বরং এটি হবে সন্তোষজনক মাত্রায়। আলোচনায় যুক্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যেখানে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শেষ হয়েছিল দ্বিধায়, সেখানে এই তৃতীয় ও চূড়ান্ত ধাপ দিচ্ছে এক পরিষ্কার সংকেত—আমাদের অবস্থান মূল্যায়ন পেয়েছে।’
ওয়াশিংটনে মার্কিন বাণিজ্য দপ্তর ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ বা ইউএসটিআরের সঙ্গে চলমান বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান এবং অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাওসার চৌধুরী রয়েছেন সঙ্গে। মার্কিন পক্ষে আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইউএসটিআরের সহকারী ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ ব্রেন্ডন লিঞ্চ। পুরো আলোচনা সমন্বয় করছেন ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা।
প্রথম দিনের আলোচনায় বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কমানোর বিষয়ে ‘ইতিবাচক ইঙ্গিত’ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব ছিল—যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া পণ্যের ওপর শুল্কহার যেন ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
এই প্রস্তাবের পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক নজির—ভিয়েতনাম ২০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন ১৯ শতাংশ, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৫ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্য ১০ শতাংশ হারে এমন সমঝোতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশের দাবি, এই পরিসরেই একটি যৌক্তিক ও প্রতিযোগিতামূলক হার নির্ধারণ সম্ভব।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আলোচনায় সম্পৃক্ত সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, দ্বিতীয় দিনের আলোচনায় শুধু বাণিজ্য নয়, জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্র থেকেও যুক্তরাষ্ট্র এই আলোচনা পর্যালোচনা করছে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক, বাণিজ্যচিত্র এবং ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানও আলোচনার কাঠামোয় স্থান পেয়েছে।
সূত্র জানায়, দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে এ বিষয়েও একটি কাঠামোগত আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, বাংলাদেশ একটি নির্দিষ্ট কৌশলগত নীতিপথ অনুসরণ করুক।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে মার্কিন পক্ষকে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে বড় আকারে পণ্য আমদানির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে সরকারি পর্যায়ে এক বছরের মধ্যে দেড় বিলিয়ন ডলারের গম, ডাল এবং এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ৭ লাখ টন গম কেনার চুক্তি ইতিমধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং আরও ২ দশমিক ২০ লাখ টনের প্রস্তাব অনুমোদনের অপেক্ষায়। পাশাপাশি ২৫টি বোয়িং বিমান কেনার জন্য অগ্রিম অর্ডারও দেওয়া হয়েছে।
বেসরকারি পর্যায়েও নেওয়া হয়েছে বড় উদ্যোগ। বাংলাদেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী—বিটিএমএ, টিকে গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ ও সিটি গ্রুপের প্রতিনিধিরা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন এবং মার্কিন রপ্তানিকারকদের সঙ্গে সম্ভাব্য চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করছেন। বাণিজ্যসচিব জানান, সম্মিলিতভাবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানির সম্ভাবনা রয়েছে।
এতে এত দিন ধরে আটকে থাকা শুল্কসংক্রান্ত জট খুলতে শুরু করেছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রস্তাব এবং রপ্তানিকেন্দ্রিক প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক প্রতিফলন ফেলেছে।
বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার ফলাফলের দিকে। এই সমঝোতা শুধু দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের গতি নির্ধারণ করবে না, একই সঙ্গে উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য এক নতুন মাইলফলক হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।
চূড়ান্ত ঘোষণা আসতে এক-দুই দিনের বেশি সময় লাগবে না বলেই মনে করছেন আলোচনায় জড়িত কর্মকর্তারা। তবে এখনই জনসমক্ষে মন্তব্য করতে তারা রাজি নন। এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, 'চূড়ান্ত ফলাফলের আগে প্রতিটি বাক্যই এখন কূটনৈতিক গুরুত্ব বহন করছে।'
বাংলাদেশ যে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে একটি কঠিন দরকষাকষির মধ্যে পড়েও স্থিরতা বজায় রেখে এগোচ্ছে, তা এই আলোচনার গতি ও ধরন থেকেই পরিষ্কার। আর তারই ফলস্বরূপ—শুল্ক হ্রাসের পথে এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা।