কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক
ঋণের ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক মালিকদের দখলে
-1180954.jpg?v=1.1)
২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বেসরকারি ব্যাংক পরিচালকদের নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা, যেখানে ২০২৩ সালের আগস্ট শেষে এ অঙ্ক ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার ১২৩ কোটি। ফলে মাত্র চার মাসের ব্যবধানে পরিচালকদের ঋণ কমেছে ৫৯ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, সরকার পরিবর্তনের পর অনেক পরিচালক ব্যাংকের বোর্ড থেকে বাদ পড়ায় তাদের নেওয়া ঋণও কমে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতে পরিচালকদের অনিয়ম ও অর্থ লোপাট নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক নিজ ব্যাংক থেকে পরিচালকদের ঋণ নেওয়ার বিষয়ে কঠোর বিধি জারি করে। এরপর থেকেই তারা নিজেদের ব্যাংকের বদলে অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিপুল অঙ্কের ঋণ তুলতে থাকেন। একে অপরের ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে চলছিল এই প্রক্রিয়া, যা মূলত একটি সুসংগঠিত লুটপাটে পরিণত হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বেসরকারি ব্যাংক পরিচালকদের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালের আগস্টে—যখন দেশে সরকার পরিবর্তন ঘটে—ঋণের অঙ্ক ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার ১২৩ কোটি টাকা।
ফিরে তাকালে দেখা যায়, ২০২০ সালে এই পরিচালকদের ভাগাভাগির ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। অথচ ২০১৬ সালে, এস আলম গ্রুপের ‘ব্যাংক সাম্রাজ্য’ গড়ে ওঠার আগেই এই ঋণ ছিল মাত্র ৯০ হাজার কোটি টাকার মতো।
এস আলম গ্রুপের প্রভাব বিস্তারের পর ব্যাংক খাত কার্যত একক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায় বলে অনেকেই মনে করেন। মাত্র আট বছরে ব্যাংক পরিচালকদের মোট ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৩৫ হাজার কোটির বেশি, অর্থাৎ এই সময়ের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৬০ শতাংশ।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, "যেসব ব্যাংক থেকে বিভিন্নভাবে ঋণ বেরিয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে এরই মধ্যে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করেছে। আমার জানামতে, ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিচালকদের ঋণ সংক্রান্ত আইনটিতে দুর্বলতা আছে। এজন্য তারা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে বিভিন্নভাবে ঋণ বের করে নিয়ে যাচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে যাতে আইনের এ ধরনের অপব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।"
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ব্যাংকের মোট পরিচালকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭০০। তবে তাদের মধ্যে সমঝোতাভিত্তিক বড় অঙ্কের ঋণ অনিয়মে জড়িত শখানেক পরিচালক, যারা ছিলেন এস আলম, বেক্সিমকো, নাসাসহ হাতেগোনা ১১টি গ্রুপের ‘এজেন্ট পরিচালক’। কিন্তু গত আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার বদলের পর ব্যাংক খাতে এসব গ্রুপের ক্ষমতা খর্ব হয়। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে বাদ পড়ে তাদের পরিচালকরা। যদিও অনেকে শেয়ারহোল্ডার পরিচালক হিসেবে এসব ব্যাংকে রয়েছেন। সেই হিসেবে তাদের পরিচালক ঋণের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এতে আগস্ট থেকে ডিসেম্বরে মাত্র চার মাসে পরিচালক ঋণ ৬০ হাজার কোটি টাকা কমে ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। মূলত ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়ায় এমনটি ঘটেছে। সামনে আরও কমার আভাস দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের হিসাবে এই ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিভিন্ন ব্যাংক পরিচালকদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা বা ঋণ দিয়ে শীর্ষ অবস্থানে ছিল এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংক থেকে পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। এর পরের অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালকরা ঋণ নেন ১০ হাজার কোটি টাকা। বেক্সিমকো গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন পরিচালকরা নেন ১০ হাজার কোটি। এ ছাড়া সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, "এস আলম, বেক্সিমকো, নাসা গ্রুপসহ শক্তিশালী ব্যবসায়িক গ্রুপগুলো রাজনীতির অপব্যবহার এবং আইনের ফাঁকগুলোর সুযোগ নিয়ে অনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে, যা দেশের পুরো আর্থিক খাতকে গুরুতর ঝুঁকিতে ফেলেছে। আটটি ব্যাংকের যেসব পরিচালক এ ধরনের ঋণের সঙ্গে জড়িত, তারা সম্মিলিতভাবে দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন দিয়েছেন। আর তারা একে অপরের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন ৪৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, তাদের পরিশোধিত মূলধন ঋণের মাত্র পাঁচ শতাংশ। ব্যাংক খাতে অনিয়মের মূলত পুরোধা ছিলেন বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। তিনি ২০১৭ সালে নগ্নভাবে ব্যাংক দখল করে এসব অন্যায়কে উসকে দেন। এ ছাড়া নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ছিলেন ব্যাংক খাতের আরেক আতঙ্ক।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০১৪ সালের এক সার্কুলার অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের পরিচালকদের নিজ নিজ পরিশোধিত মূলধনের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান গণমাধ্যমকে জানান, “ব্যাংক খাতে আগস্টের আগে যা ঘটেছে তা সবার জানা। বিশেষ করে কয়েকটি গ্রুপ ব্যাংকের বারোটা বাজিয়েছে। আর পরিচালকদের ঋণ কোন ব্যাংক থেকে কত, তার পুরো হিসাব কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করে না। তবে আগস্টের পটপরিবর্তনে ব্যাংক খাত ঘুরে দাঁড়াতে সব চেষ্টা চলমান। সামনে ভালো কিছু ঘটবে।”