যে কারণে বারবার বায়ুদূষণে শীর্ষেই থাকছে ঢাকা
দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় প্রায়ই প্রথম হচ্ছে ঢাকা। শীতের সময় ঢাকার বায়ুদূষণ বাড়লেও এবার শীত শুরুর বেশ আগে থেকেই রাজধানীর বাতাসে দূষণের পরিমাণ বেড়ে গেছে বলে জানা গেছে। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের সূচকে গত দুই মাসে ঢাকা একাধিকবার ৩০০’র বেশি একিউআই স্কোর নিয়ে সর্বোচ্চ দূষিতের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। খবর বিবিসি বাংলার।
আগের কয়েকটি বছরের ধরন অনুযায়ী, বাংলাদেশে সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বায়ুর মান এতটাই খারাপ থাকে যে এই পাঁচ মাসে সারা বছরের প্রায় ৬৫ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে।
আগের সব রেকর্ডকে ভেঙে বারবার দূষণের তালিকায় ঢাকার শীর্ষে চলে আসার পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণকে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীতে সারাবছরই ছোট-বড় অজস্র ভবন নির্মাণ এবং রাস্তা মেরামতের কাজ চলে। এর পাশাপাশি গত কয়েক বছরে যোগ হয়েছে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন বড় প্রকল্প।
যেকোনো ধরনের নির্মাণকাজ করার সময় বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে সেসব নিয়ম পালনের তোয়াক্কা করতে দেখা যায় না।
রাস্তা ও ভবন নির্মাণ বা মেরামতের সময় ধুলাবালি যেন বাতাসের সঙ্গে যেন মিশে না যায়, সে জন্য নির্মাণ স্থানে যথাযথ অস্থায়ী ছাউনি বা বেষ্টনী দেয়ার নিয়ম রয়েছে। সেই সাথে, বেষ্টনীর ভেতর ও বাইরে নির্মাণসামগ্রী (মাটি, বালি, রড, সিমেন্ট ইত্যাদি) যথাযথভাবে ঢেকে রাখা এবং দিনে কমপক্ষে দুবার স্প্রে করে পানি ছিটানোর কথা বলা আছে এতে।
এ ছাড়া নির্মাণাধীন রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখে বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা করা, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত করা এবং নির্মাণসামগ্রী ঢেকে পরিবহন করার কথাও বলে অধিদপ্তর।
ভবন ও রাস্তাঘাট নির্মাণের ক্ষেত্রে যদি কেউ এইসব নিয়ম পালন না করে, সেক্ষেত্রে ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করার পাশাপাশি জরিমানা আরোপ করতে পারবে সিটি করপোরেশন।
দূষণবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ক্যাপস-এর ‘দেশব্যাপী ৬৪ জেলার বায়ু দূষণ সমীক্ষা ২০২১’ অনুযায়ী, ঢাকার আশেপাশের প্রায় ১২০০টি ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্পকারখানা আছে, যেগুলো দূষণের অন্যতম কারণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ ইটভাটা এখনও সনাতন পদ্ধতিতে চলছে। এসব ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কয়লা, কাঠ ব্যবহার করা হয়। ফলে এটা থেকে প্রচুর ছাই তৈরি হয় এবং কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের মতো দূষিত কণা বাতাসের সঙ্গে মেশে।
বায়ুদূষণ হ্রাস করার লক্ষ্যে ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯)’ শীর্ষক আইনও গৃহীত হয়। কিন্তু সেই আইনেরও তেমন প্রয়োগ নেই।
হাসান নামে একজন বলেন, এই ইটের ভাটাগুলো শুষ্ক মৌসুমে চলমান থাকে। শীতকালে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কম থাকার ফলে এই সময়ে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায়।
শহরের যে কোনো রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই দেখা যাবে, চারপাশকে কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে বিকট শব্দে ছুটে চলছে বিভিন্ন ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বিশেষ করে বাস ও ট্রাক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে এখনো অবলীলায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি ঘুরে বেড়াতে পারছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং ট্র্যাফিক পুলিশদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে।
বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ঢাকা শহরে যে পরিমাণ বাস চলে, তার সত্তর শতাংশেরই আয়ুষ্কাল শেষ। লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলো চলছে, এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো মনোযোগ নেই।
তিনি জানান, ঢাকায় এখন কমপক্ষে সাড়ে চার হাজার বাস চলছে কিন্তু সেসবের সত্তর শতাংশেরই কোনো ‘ইকোনমিক লাইফ’ অর্থাৎ ‘অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল’ নেই।
অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল না থাকার অর্থ হলো যখন কোনও যানবাহন ভারী মেরামত না করার কারণে সড়কে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এই অধ্যাপক জানান, ঢাকা শহরে যেসব বাস চলছে, সেগুলোর ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের অবস্থা এতটাই খারাপ যে সেগুলো মেরামত করারও অনুপযোগী।
ঢাকার সড়ককে ফিটনেসবিহীন যানবাহনমুক্ত করার জন্য পরিচালিত মোবাইল কোর্টের বিষয়ে মন্তব্য করেন অধ্যাপক মজুমদার। তিনি বলেন, এই গাড়িগুলোর যে ফিটনেস নেই, তা বোঝার জন্য গবেষণা করা লাগে না, এগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। কিন্তু কোনো এক রহস্যজনক কারণে আমরা এগুলোকে এখনো ফেজ আউট করতে পারি নাই। এগুলো ঢাকার রাস্তায় দিব্যি চলাচল করছে।
সর্বোপরি আমাদের জনসচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া বায়ূ দূষণ কমানো সম্ভব নয়।