গুজব প্রতিরোধে ইসলামের বার্তা

গীবত ও গুজবের সম্পর্ক ধর্মীয় সতর্কতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:০০ PM

গুজব হলো মিথ্যা, ভিত্তিহীন এবং ক্ষতিকর তথ্য বা গল্প; যা সাধারণত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং সমাজে বিভ্রান্তি, বিশৃঙ্খলা ও ক্ষতি ডেকে আনে। এটি কারও ব্যক্তিত্ব, সম্প্রদায়ের ঐক্য বা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে গুজব প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করেছে; যা সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করে। কোরআন ও হাদিসে গুজব ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে সতর্কতা ও প্রতিরোধের জন্য নীতিমালা উল্লেখ রয়েছে। ইসলাম যেভাবে গুজব প্রতিরোধে ভূমিকা রেখেছে, তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

গুজবের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা: কোরআনের নির্দেশনা
গুজব প্রতিরোধে ইসলামের প্রধান নির্দেশনা এসেছে কোরআন থেকে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা গুজব ছড়ানো এবং মিথ্যা প্রচার করা থেকে বিরত থাকার জন্য মুসলমানদের কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। গুজব থেকে সৃষ্ট অপব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তি যে কতটা বিপজ্জনক, তা কোরআন স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে-


‘হে মুমিনগণ! যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তা যাচাই করো, যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত না কর এবং পরবর্তীতে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তোমরা অনুতপ্ত না হও।’ (সুরা হুজুরাত, ৪৯:৬)

এ আয়াতটি পরিষ্কারভাবে নির্দেশ করে যে, কোনো তথ্য যাচাই করা ছাড়া তা গ্রহণ বা প্রচার করা উচিত নয়। যাচাই না করে কোনো গুজব বা মিথ্যা কথা বিশ্বাস করা ইসলামিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

মিথ্যার বিপদ: গুজবের প্রকৃত রূপ
গুজব মূলত মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ইসলাম মিথ্যাকে সম্পূর্ণরূপে হারাম করেছে এবং এটিকে একটি বড় পাপ হিসেবে উল্লেখ করেছে। নবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন,

‘মিথ্যা হলো পাপ এবং পাপ মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।’ (সহিহ মুসলিম)


গুজব হলো একটি মিথ্যা তথ্য, যা এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির কাছে ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমাগত বিকৃত হয়। এটি সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে এবং লোকদের মধ্যে অবিশ্বাস ও শত্রুতার জন্ম দেয়। ইসলাম এই ধরনের মিথ্যাচার থেকে কঠোরভাবে সতর্ক করে এবং মুসলমানদের সর্বদা সত্য এবং ন্যায়ের পথে চলার আহ্বান জানায়।

গীবত ও গুজবের সম্পর্ক: ইসলামের নিষেধাজ্ঞা
গুজব সাধারণত গীবতের (পরনিন্দা) সঙ্গে সম্পর্কিত, কারণ এতে প্রায়ই কারো পিছনে মিথ্যা বা খারাপ কথা বলা হয়। গীবত বা পরনিন্দা ইসলামে নিষিদ্ধ এবং এটি সমাজে শত্রুতা ও বিভেদ সৃষ্টি করে। আল্লাহ বলেন,

‘আর একজন অপরজনের গীবত কর না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? নিশ্চয়ই তোমরা তা ঘৃণার বিষয় মনে করবে।’ (সুরা হুজুরাত, ৪৯:১২)


গুজব ছড়ানো মানে প্রায়ই কারও সম্পর্কে অবমাননাকর তথ্য প্রচার করা, যা তার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। ইসলামে এটি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ, কারণ এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও শৃঙ্খলার জন্য হুমকিস্বরূপ।

সাবধানতা ও যাচাই: ইসলামি দায়িত্ব
ইসলাম প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তথ্য যাচাই করার এবং যাচাই না করে কোনো সংবাদ প্রচার না করার দায়িত্ব দিয়েছে। ইসলামের শিক্ষা হলো, কোনো ব্যক্তির সম্মান, নিরাপত্তা বা মর্যাদা যেন ভুল তথ্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

‘কোনো ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হিসেবে যথেষ্ট যে, সে শোনা কথা যাচাই না করে প্রচার করে।’ (সহিহ মুসলিম)

এ হাদিসটি স্পষ্ট করে দেয় যে যাচাই ছাড়া কিছু প্রচার করা মিথ্যার পর্যায়ে পড়ে, যা একটি বড় গুনাহ।

গুজবের বিরুদ্ধে সামাজিক ও আইনি ব্যবস্থা:
ইসলাম শুধু ব্যক্তিগতভাবে নয়, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও গুজবের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামী খিলাফতে গুজব এবং মিথ্যাচার প্রচারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হতো। সঠিক তথ্য প্রচার, বিভ্রান্তি দূরীকরণ এবং সমাজে সুষ্ঠু তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব ছিল।


ইসলামিক সমাজ ব্যবস্থায় গুজব প্রতিরোধের লক্ষ্যে সমাজের প্রতিটি সদস্যকে তথ্য যাচাইয়ের জন্য দায়িত্বশীল হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র ও ব্যক্তিগত স্তরে উভয় দিক থেকেই তথ্যের যাচাই এবং ভুল তথ্যের প্রচার রোধের ব্যবস্থা থাকা উচিত।

গুজব থেকে রক্ষা: আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আল্লাহভীতি
ইসলামিক মূল্যবোধ গুজব প্রতিরোধে আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আল্লাহভীতির উপর জোর দেয়। একজন মুমিনের উচিত সবসময় সত্যনিষ্ঠ থাকা এবং কোনো মিথ্যা বা গুজবের প্রচার থেকে বিরত থাকা। আল্লাহভীতি মানুষের মধ্যে সৎ চিন্তা এবং সঠিক কাজ করার প্রেরণা জোগায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

‘তোমরা সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।’ (সুরা আত-তাওবা, ৯:১১৯)

সত্যবাদীদের সান্নিধ্যে থাকা গুজব এবং মিথ্যার ক্ষতি থেকে মানুষকে রক্ষা করে। যারা আল্লাহকে ভয় করে, তারা গুজব ছড়ানো থেকে সবসময় দূরে থাকে।

ইসলাম গুজব প্রতিরোধে যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে, তা মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সমগ্র সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, গুজবের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রত্যেক মুমিনকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে, তথ্য যাচাই করতে হবে, এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে হবে। গুজবের মিথ্যা প্রতারণা থেকে মুক্ত থাকতে আল্লাহর প্রতি ভয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণই সর্বোত্তম মাধ্যম। ইসলামি সমাজের জন্য এই দায়িত্ব শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। গুজব প্রতিরোধে ইসলাম আমাদের জন্য যে মূল্যবোধ ও নীতিমালা প্রদান করেছে, তা অনুসরণ করলে সমাজে শান্তি, ঐক্য এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠা হবে।