‘নিরাপত্তা বাহিনীর বেষ্টনীবদ্ধ হয়ে ধর্ম পালন করাটা হাস্যকর’

নিজস্ব প্রতিবেদক
জার্নাল ডেস্ক জার্নাল ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬:৫৬ PM

আমরা জাতি হিসেবে ব্যর্থ হতে চাই না বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন আমাদের তরুণরা জেগেছে, আমাদের মানুষ জেগেছে। আমরা নতুন বাংলাদেশের কথা বলছি। সেটা নিশ্চিত করতে চাই। তা না হলে এত রক্তপাতের, এত আত্মত্যাগের কী ফল পেলাম? আমাদের ছেলেমেয়েরা ২৪-এর জুলাইয়ে যে অসাধ্য সাধন করেছে, তাদের মূল লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। এখানে সব নাগরিক সমান সুযোগ পাবে।

মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পরিদর্শনে গিয়ে এসব কথা বলেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা সে যে ঘরেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন, সে ছেলে হোক আর মেয়ে হোক, সবাই নাগরিকের সমান সুবিধা পাবে। পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার শক্তি তাদের আছে। তারা কেউ বন্দি থাকার জন্য জন্মগ্রহণ করেনি। কারো ভয়ে পালিয়ে থাকার জন্য জন্মগ্রহণ করেনি। আমরা তাদেরকে সেই সুযোগ দিতে চাই। তারা নিজের মতো করে গড়ে উঠবে। দেশকে গড়ে তুলবে। পৃথিবীকে গড়ে তুলবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা এমন রাষ্ট্র গঠন করতে চাই, পৃথিবী আমাদেরকে অনুসরণ করবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা বৈষম্য, দুর্নীতিমুক্ত একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ার যে অগ্রযাত্রা শুরু করেছি, তার সব বাস্তবায়ন করতে হলে ধর্ম, বর্ণ, ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সব অশুভ, অন্যায়, অন্ধকারকে পরাজিত করে ঐক্য ও সম্প্রীতির জয় হবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথে।

ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা ঐক্যের কথা বলি। যে ঐক্যের কথা আমরা বলি সেই ঐক্য দুর্গাপূজার কাঠামোর মধ্যেই আছে। লক্ষ্মীর ধনসম্পদ, সরস্বতীর জ্ঞান, কার্তিকের বীরত্ব, গণেশের সাফল্য, দশভূজা দুর্গার অসীম শক্তি সম্মিলিতভাবে সমস্ত অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে। এর মধ্যেই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চিত্র আছে। জ্ঞান নিয়ে, সম্পদ নিয়ে, শক্তি নিয়ে সবাই যার যার শক্তি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হলে আমরা সব অশুভ শক্তিকে পরাজিত করতে পারব। এর থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করে, এ সাধ্য কারো নেই। নিজেরা বিভক্ত হয়ে গেলে, ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে আমরা জাতি হিসেবে ব্যর্থ হয়ে গেলাম।’

তিনি বলেন, আমরা একটি পরিবার। সারা জাতি একটা পরিবার। পরিবারের মধ্যে নানা রকমের মতভেদ থাকবে, নানা রকমের ব্যবহারের পার্থক্য থাকবে, কিন্তু পরিবার একটা অটুট জিনিস। এটাকে কেউ ভাঙতে পারে না। আমরা যেন জাতি হিসেবে এই অটুট একটা পরিবার হিসেবে দাঁড়াতে পারি, সেটাই হলো আমাদের লক্ষ্য।

তিনি আরও বলেন, যত ধর্মীয় পার্থক্য থাকুক, মতের পার্থক্য থাকুক, যত রকমের পার্থক্যই থাকুক, রাষ্ট্র আমাদের প্রতি কোনো পার্থক্য করতে পারবে না। রাষ্ট্র দায়িত্ববদ্ধ সবাইকে সমান মর্যাদা দেওয়ার জন্য, সে যেই হোক। সে যে ধর্মে বিশ্বাস করুক, যে মতবাদে বিশ্বাস করুক, অসীম ধনের অধিকারী হোক অথবা নিঃস্ব হোক- রাষ্ট্রের কাছে সে একজন নাগরিক। নাগরিকের সমস্ত অধিকার সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা আছে। কোনো সরকারের অধিকার নেই, তাকে কোনো জায়গা থেকে বঞ্চিত করা, ক্ষুদ্র পরিমাণে বঞ্চিত করা। কাজেই আমাদেরকে ওই একটা জায়গাতে সোচ্চার হতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমার প্রতি কোনো রকমের বৈষম্য করা যাবে না। রাষ্ট্র আমার প্রাপ্যকে নিশ্চয়তা দিয়েছে, তালিকা করে দিয়ে দিয়েছে। কাজেই যত কথাই বলি সবচাইতে বড় কথাটা বলবেন আমি নাগরিক। এই তালিকাভুক্ত সমস্ত জিনিসের অধিকার আমাকে দিতে হবে। ওইটাতে যদি না দাঁড়ান, বাকিগুলোতে বড় সুবিধা হয় না। কথার মারপ্যাঁচে এদিক ওদিক করে ফেলেন। এটাতে এদিক ওদিক করার কোনো সুযোগ নেই।

‘কাজেই আবারও আহ্বান জানাচ্ছি, আপনাদের যত কথাই বলুন। তার মধ্যে বারে বারে বলুন যে, আমি এ দেশের নাগরিক। আমার জন্য সংবিধানে দেওয়া সমস্ত নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এইসব অধিকার থেকে এখন আমি বঞ্চিত, এগুলো আমাকে দিতে হবে। তখন আপনি সঙ্গী সাথী সবাইকে পাবেন। সারা দেশের মানুষ একসঙ্গে থাকবে। কারণ সবারই একই সমস্যা, তার নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আমরা বারে বারে লাঞ্ছিত হই, অপমানিত হই, আমরা নানা রকমের বৈষম্যের শিকার হই, যেহেতু ওই অধিকারের প্রতি আমাদের নজর নেই বা হতাশ হয়ে গেছি। অধিকারের কথা মুখে আসে না। এখন আসতে হবে। আমরা যে নতুন বাংলাদেশের কথা বলছি, তার মধ্যে এটা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সবাইকে সব নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা। সেটা যেন আমরা করতে পারি।’

নিরাপত্তা বাহিনীর বেষ্টনীর মধ্যে আমাদের ধর্ম পালন করতে চাই না জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, আমরা নাগরিক হিসেবে মুক্তভাবে, যার যার ধর্ম পালন করতে চাই। এই অধিকার আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। আমরা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা পালন করার জন্য তাদের সবার প্রতি ধন্যবাদ জানাই।

নিরাপত্তা বাহিনীর বেষ্টনীবদ্ধ হয়ে ধর্ম পালন করাটা হাস্যকর জিনিস হয়। এটা কি কোনো কথা হলো? এটা কোন দেশ, কোন ধরনের দেশ আমরা বানালাম। এরকম দেশ বানানোর জন্যই এত রক্তপাত, এত কিছু হলো, আমরা সেটা চাই না। আমরা সম্পূর্ণ নিরাপত্তার মধ্যে, সম্পূর্ণ বিশ্বাসের মধ্যে, আমরা আমাদের যার যার মত, যার যার ধর্ম পালন করতে চাই। এই নিশ্চয়তা চাই।