এসএসসিতে থাকছে ৫ ঘণ্টার বোর্ড পরীক্ষা; আরো যে পরিবর্তন আসছে
মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার (এসএসসি) মূল্যায়ন পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনা হচ্ছে৷ জানা গেছে, অভিভাবকদের আপত্তি ও সমালোচনার মুখে এই পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পরিবর্তিত এই পদ্ধতিতে শিক্ষা বোর্ডের অধীনে আংশিক (৫০ ভাগ নম্বরের) পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ সেখানে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত মূল্যায়ন থাকবে৷ আর প্রতি বিষয়ে ৫০ নম্বরের এই বোর্ড পরীক্ষা হবে পাঁচ ঘণ্টায়৷
বাকি ৫০ নম্বরের মূল্যায়ন করবেন যার যার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা। সারা বছরের শিখন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকেরা৷ প্রতিটি বিষয়ে মোট এই ১০০ নম্বরের পরীক্ষা৷ এর আগে পুরো ১০০ নম্বরের পরীক্ষাই শিখন প্রক্রিয়ার মধ্যে হওয়ার কথা ছিলো৷ এজন্য বোর্ড পরীক্ষা বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল৷
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান জানান, ‘‘অভিভাবকদের কিছুটা আপত্তি এবং বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা কথা বলে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনছি৷ আমরা একটি কমিটি গঠন করেছিলাম৷ ওই কমিটির রিপোর্ট ও সুপারিশের ভিত্তিতে এটা করা হচ্ছে৷ এটা বেসিক কোনো পরিবর্তন নয়৷''
তিনি জানান, বছরব্যাপী একটি মূল্যায়ন হবে, যেটা যার যার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা করবেন৷ আর চূড়ান্ত পর্যায়ে আরেকটা মূল্যায়ন হবে৷ সেটা একদিনে বোর্ডের অধীনে হবে৷ পরীক্ষার সিট পড়বে অন্য স্কুলে৷ পরিদর্শকও থাকবেন অন্য স্কুলের শিক্ষক৷ পরীক্ষার পর উত্তরপত্র বোর্ডে চলে যাবে৷ সেখান থেকে তারা অন্য শিক্ষকদের মূল্যায়নের দায়িত্ব দেবেন৷ ‘‘প্রতিটি বিষয়ে পরীক্ষার দিন সকাল ১০টা থেকে ১টা তিন ঘণ্টা এবং এক ঘণ্টা ব্রেক দিয়ে আবার দুই ঘণ্টা এই মোট পাঁচ ঘণ্টার পরীক্ষা হবে৷ প্রথম তিন ঘণ্টায় শিক্ষার্থীরা একটি বিষয় নিয়ে কাজ করবে৷ সেখানে ওই কাজে তাদের পারদর্শিতা, প্রেজেন্টেশন এসব দেখা হবে৷ পরের দুই ঘণ্টায় তারা যেটা করেছে সেটা পরীক্ষার থাকায় লিখে দেবে৷ এটা সবমিলিয়ে মোট ৫০ নম্বরের হবে'' বলে জানান অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান৷ আর বাকি ৫০ নম্বর সারাবছরের মূল্যায়ন৷ সেটা আগেই করা হবে৷ মার্কশিটে দুইটি রেজাল্ট আলাদাভাবে থাকবে বলে জানান তিনি৷
এর আগে মূল্যায়ন পুরোটাই যে স্কুলের ছাত্র সেই স্কুলের শিক্ষদের হাতে ছিলো৷ গত বছরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে সেভাবেই শিক্ষকেরা মূল্যায়ন করেছেন৷ কিন্তু এসএসসি পরীক্ষায় নতুন পদ্ধতিতে হবে৷
অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘‘আগে বোর্ড পরীক্ষার বিষয়টি না থাকায় কেউ কেউ আপত্তি করেছেন৷ আবার একই সাবজেক্টের একাধিক দিনে শিক্ষার্থীদের নানা কাজ ও প্রেজেন্টেশন দেয়ায় কেউ কেউ সেটা ইউটিউব বা অন্যের কাছ থেকে কপি করত বলে অভিযোগ ওঠে৷ এবার সেটার অবসান ঘাটানো হলো৷''
কারিকুলাম কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. তারিক হাসান বলেন, ‘‘পাঁচ ঘণ্টার পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের একটি সমস্যা সমাধান করতে দেয়া হবে৷ সেটা তাদের অ্যাকটিভিটিজ৷ আর তার সঙ্গে মিলিয়ে আবার প্রশ্ন থাকবে যার উত্তর লিখিতভাবে দিতে হবে৷ এখানে এই দুই পর্যায়ে সমান নম্বর থাকবে৷''
তিনি জানান, ‘‘এখানে প্র্যাকটিক্যাল ও লিখিত পরীক্ষার নম্বর সমান হবে৷ আর নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে, বাইরের শিক্ষকরা এই পরীক্ষা নেবেন৷ এটার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হবে৷''
শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং এই বোর্ড পরীক্ষার মূল্যায়ন রিপোর্ট কার্ডে আলাদাভাবে উল্লেখ থাকবে বলে জানান তিনি৷ মাধ্যমিকের অন্যান্য শ্রেণিতেও একই মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে বলে তিনি জানান৷ এসএসসিতে মোট ১০ বিষয়ে পরীক্ষা হবে৷
তবে পরীক্ষার মূল্যালয়নে এই পরিবর্তনে আশার কিছু দেখছেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান৷ তিনি বলেন, ‘‘আসলে আগে আমাদের প্রয়োজন শিক্ষক এবং অবকাঠামো৷ আমরা যে নতুন পাঠক্রম করছি তার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ শিক্ষক এবং অবকাঠামো আছে কী না তা আগে দেখতে হবে৷ সেটা তৈরি না করেই আমরা বার বার পরীক্ষা নীরিক্ষা করছি৷ এটা ভালো ফল দেয় না৷''
‘‘আর অভিভাবকেরা বললেই একটা কিছু করতে হবে সেটা কোনো যুক্তি নয়৷ আসলে যেটা আমরা পারব, যেটা আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো সেটা করতে হবে৷ আসলে প্রস্তুতি ছাড়াই এখানে অনেক কিছু করা হচ্ছে,'' বলেন তিনি৷ অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমানের মতে, ‘‘আমাদের এখানে এখন ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন ছেড়ে দেয়া হচ্ছে৷ এটা অসাধু প্রক্রিয়া তৈরি করতে পারে৷''
আর শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘‘বার বার এমন পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো কোনো ফল আনতে পারে না৷ এটা প্রমাণ করে আমরা আসলে কী করতে চাই আমরা নিজেরাই তা ঠিকভাবে জানি না৷ এখানে এখন বাইরে থেকে প্রচুর কনসালটেন্ট আনা হচ্ছে৷ কিন্তু আমার কথা, ইংল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থার মতো এখানেও করার জন্য আমরা কি প্রস্তুত?''
তার কথা, ‘‘এখানে শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে কম৷ ফলে মেধাবীদের এখানে পাওয়া যায় না৷ কেউ ভালো চাকরি পেলেই শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে চলেও যায়৷ তাহলে আমরা যা করতে চাচ্ছি তা কীভাবে সম্ভব?''
তিনি বলেন, ‘‘সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি এখানে ব্যর্থ হলো৷ কেন ব্যর্থ হলো তা কী জানানো হয়েছে? এখন আবার কয়েক দিন পর পরই নানা পরিবর্তন করা হচ্ছেছ৷ শিক্ষা নিয়ে এই অস্থিরতা চলে না৷''
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘‘এসএসসিতে বোর্ড পরীক্ষা পুরোই বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল৷ সেই জায়গা থেকে আমরা এর প্রতিবাদ করেছিলাম৷ কারণ পাবলিক পরীক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ সেখান থেকে এখন অর্ধেক মূল্যায়ন বোর্ডের অধীনে আনা হচ্ছে এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই৷ তবে দেখতে হবে এটা কেমন কাজ করে৷''
তার কথা, ‘‘আগে যে পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছিল তাতে ইউটিউব বা অন্যেরটা দেখে অ্যাসাইনমেন্ট করা যেত৷ আর শিক্ষকদের কেউ অনৈতিক কাজ করলে তা নিয়ে কিছু করার থাকত না৷ তবে তা পুরাটা দূর হচ্ছে না৷''
তথ্যসূত্র: ডয়চে ভেলে