এয়ারলাইন্স জিএসএ নিয়োগ আইন অপরিবর্তিত রাখার দাবিতে মানববন্ধন
এয়ারলাইন্স জিএসএ নিয়োগ আইন অপরিবর্তিত রাখার দাবিতে মানববন্ধন করেছেন এয়ারলাইন্সের জিএসএ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
আজ রবিবার (২ নভেম্বর) সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল থেকেই এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান করছেন। এ সময় তাদের হাতে "দেশে বেকার বাড়ানোর ষড়যন্ত্র রুখে দাও", "বিদেশি চক্রান্তে দেশে নতুন করে বেকার সৃষ্টি হতে দিবো না", "দেশের মানব সম্পদ, দেশের চাকরি হারাতে দেবো না"- সম্বলিত বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে।
মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীরা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কার্যকর থাকা জিএসএ নিয়োগ আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তা শিল্পের স্থিতিশীলতা ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তারা দাবি জানান, সরকার যেন বিদ্যমান আইন অপরিবর্তিত রাখে এবং সংশ্লিষ্টদের মতামত ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, বর্তমান জিএসএ নিয়োগ আইন দেশের বিমান পরিবহন খাতকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে সহায়তা করছে। এই আইন পরিবর্তনের কোনো যৌক্তিকতা নেই। নতুন কোনো নীতিমালা প্রবর্তন করা হলে তা দেশীয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থের পরিপন্থী হবে এবং বিদেশি স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে।
তারা আরও বলেন, জিএসএ নিয়োগ আইনে পরিবর্তন আনা হলে ছোট ও মাঝারি ট্রাভেল এজেন্সিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার ফলে বিপর্যস্ত হতে পারে দেশের বিমানবাজার।
বক্তারা সরকার ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) প্রতি আহ্বান জানান, বিদ্যমান আইন অপরিবর্তিত রেখে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
মানববন্ধনে বিভিন্ন এয়ারলাইনসের প্রতিনিধি, ট্রাভেল এজেন্সির মালিক ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনের নেতারা অংশ নেন।
উল্লেখ্য, এর আগে বাংলাদেশে বিদেশি বিমান সংস্থাগুলোর জন্য জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) নিয়োগের বিষয়টি ঐচ্ছিক করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে অংশীজনদের নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এ প্রস্তাব করা হয়।
মন্ত্রণালয়ের সভায় উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জোর দিয়ে বলেন, সরকার জাতীয় স্বার্থরক্ষা এবং বিমান চলাচল খাতে ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি কৃত্রিম টিকিট সংকট সৃষ্টি, অযৌক্তিক ভাড়া বৃদ্ধি, মানব পাচারে সহায়তা করে এমন কার্যকলাপসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জিএসএ নিয়োগের বিষয়ে আলোচনায় অংশীজনেরা একে ঐচ্ছিক করার প্রস্তাব করেন, যাতে এয়ারলাইনসগুলো তাদের পরিচালনগত প্রয়োজনীয়তা এবং ব্যবসায়িক কৌশলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
যৌক্তিক মূল্যে টিকিট যাত্রীদের কাছ পৌঁছে দেওয়া বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার। দেশের শ্রমিক শ্রেণি বিদেশযাত্রার ক্ষেত্রে যাতে প্রতারিত না হয় সেজন্য এই উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এজন্য সরকার কঠোর আইনের ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এয়ার টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্য বাড়ানো ও সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে ১৩টি ট্রাভেল এজেন্সির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে।
জিএসএ কী?
কোনো এয়ারলাইনসের পক্ষ থেকে যেসব প্রতিষ্ঠানকে কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা অঞ্চলে তাদের সেবা বিক্রি ও বিপণনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাদেরই জিএসএ বলে। জিএসএরা বিমানের টিকিট বিক্রি ছাড়াও গ্রাহকসেবা, প্রচার, বিপণন ও ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম পরিচালনা করে।
বিদেশি বিমান সংস্থাগুলো কোনো দেশে সরাসরি নিজস্ব অফিস চালু না করে স্থানীয়ভাবে জিএসএ নিয়োগ করে থাকে। এতে তাদের খরচ যেমন কমে যায়, তেমনি পূর্ণাঙ্গ কার্যালয় পরিচালনার ঝামেলাও এড়ানো সম্ভব হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ৭০টির বেশি বিদেশি বিমান সংস্থা স্থানীয় জিএসএর মাধ্যমে ব্যবসা চালাচ্ছে। জিএসএ কার্যক্রমে সরাসরি পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করছেন। পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল আরও প্রায় ১৫ হাজার।
জিএসএ আইন বাতিল নিয়ে কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা?
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর জন্য স্থানীয় জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) নিয়োগ বাধ্যতামূলক করার বিধান বাতিল করা হলে সরকার বছরে সরাসরি ১০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাতে পারে। অতিরিক্ত ৫০০ কোটিরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা বহিঃপ্রবাহ ঘটতে পারে বলে মনে করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে অংশীজনরা জিএসএ বাধ্যতামূলক করার বিধান বাতিলের বিরোধিতা করেছেন। এরই অংশ হিসেবে গত ১ জুন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব)। তাদের মতে, এমন সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থার তত্ত্বাবধান দুর্বল করবে, স্বচ্ছতা হ্রাস করবে এবং কর্মসংস্থান ও রাজস্ব উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সূত্র জানায়, গত ৪ আগস্ট তারিখে আটাবের কমিটি ভেঙে দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। এরপর উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন বিদেশি অপারেটর কর্তৃক বাণিজ্যিক বিমান পরিবহন সেবার জন্য একক বিক্রয় প্রতিনিধি নিয়োগের বিষয়ে আইনগত বিষয় পর্যালোচনার জন্য গত ১২ আগস্ট মন্ত্রণালয়ে এক বিশেষ সভার আয়োজন করে। এরপর গত ২০ আগস্ট উপদেষ্টা বশির উদ্দীন দ্বিতীয় দফায় বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের জিএসএদের সঙ্গে জরুরি বেঠকে বসেন এবং জিএসএদের মতামতও নেন।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের আগে বাংলাদেশে অধিকাংশ বিদেশি এয়ারলাইন্স সরাসরি টিকিট বিক্রি এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করত। তখন থেকেই অভিযোগ ছিল, অসৎ এজেন্সিগুলো টিকিট বিক্রিতে অস্বচ্ছ এবং নানা রকমের জালিয়াতি করছিল। ফলে টিকিটপ্রতি বাড়তি ভাড়া নেওয়া, ভুক্তভোগীর টাকা ফেরাতে দীর্ঘসূত্রতা, ফ্লাইট বাতিল হলে ক্ষতিপূরণে জটিলতা, বিদেশ থেকে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে ট্যাক্স থেকে বঞ্চিত হতো দেশ। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বিপুল পরিমাণ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হতো। এ অবস্থায় বিমান পরিষেবা খাতের অব্যবস্থাপনা ঠেকাতে সরকার ২০১৭ সালে প্রতিটি বিদেশি বিমান কোম্পানির জন্য বাংলাদেশে ব্যবসা শুরুর আগে একক বিক্রয় প্রতিনিধি বা জিএসএ নিয়োগ করতে বাধ্য হয়। ওই আইনের বলে জিএসএরা বাংলাদেশের আইন, বিধি-বিধান মেনে কোটি গ্রাহককে সেবা দিয়ে আসছে। সর্বোপরি টিকিট বিক্রি ও অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমে সরকারের নজরদারি সহজ হয়েছে।
এ বিষয়ে গ্যালাক্সি বাংলাদেশ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ বলেন, ২০১৭ সালে যেখানে বিদেশি এয়ারলাইন্সের বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার জন্য জিএসএ নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল যৌক্তিক কারণেই। সেটি হঠাৎ করে কেন পরিবর্তন করার কথা বলা হচ্ছে- তা এই ব্যবসার মূল অংশীজন জিএসএদের কাছে ব্যাখ্যা করা হয়নি। এই আইন পরিবর্তন করে সরকার বা জনগণ কার লাভ হচ্ছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। এই আইন সংশোধন একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বাবধান প্রক্রিয়া ধ্বংস করবে এবং বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোকে স্থানীয় জবাবদিহি ছাড়াই পরিচালনার সুযোগ করে দেবে।